বই পড়তে আমরা ভালোবাসি। তাই বইমেলা নিয়ে এত উৎসাহ। এত কেনাকাটা। তবে নানা কারণে মন খানিক বইবিমুখ যে হয়ে ওঠে, তা অস্বীকার করা যায় না। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সেই মনকে একটু জড়ো করতে পারলেই বইয়ের পাতায় ফেরা আর তেমন কষ্টের কিছু হয়ে ওঠে না।
দিনকয়েকের ‘বইপাড়া’। বাঙালির সাংস্কৃতিক ক্যালেন্ডারে লাল দাগ। বইমেলার ধুলো যে ডাক পাঠায় তা কি আর উপেক্ষা করতে পারেন বইপ্রেমীরা? কলকাতায় শুরু হয়েছে বইপার্বণ। সেই চেনা ছবি। স্টলে স্টলে উৎসুক বইপোকার ভিড়। নতুন বই নিয়ে নাড়াচাড়া। বুক ভরে নেওয়া নতুন বইয়ের গন্ধ। চেনা মুখ। পরিচিত হাসি। বইকে কেন্দ্র করে এতবড় মিলনমেলা যেন বাঙালির নিজের সঙ্গে নিজের দেখা হওয়ারই পরিসর। তবে সেই আনন্দযজ্ঞের মধ্যেও দু-একটা বেয়াড়া প্রশ্ন যে ঘোরাফেরা করে না, তা তো নয়। তার মধ্যে একটি হল, বই পড়ার অভ্যাস যেভাবে শিকেয় উঠেছে, তাতে বইয়ের ভবিষ্যৎ কী?
সন্দেহ নেই যে, বই পড়ার সময়ে থাবা বসিয়েছে অন্যান্য বহু কিছু। সোশ্যাল মিডিয়া যেভাবে আমাদের রক্তে চারিয়ে দিয়েছে তাৎক্ষণিক প্রাপ্তির নেশা, সেই ইনস্ট্যান্ট গ্র্যাটিফিকেশন পেরিয়ে বইয়ের দুনিয়ায় ডুব দেওয়া দিনে দিনে কঠিন হয়ে উঠছে। কোনও একটি বিষয়ে মন দেওয়াই যেন কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে। চটজলদি স্ক্রলে এক থেকে অন্য আর-একের দিকে ছুটে যাওয়া আমাদের অভ্যাস। অথচ বই পড়া ঠিক এর উলটোদিকের পৃথিবী। এই দুয়ের সমন্বয় সম্ভব কীভাবে? জমে ওঠা বইমেলার মাঠে এ-প্রশ্নও ইতিউতি ঘুরে বেড়ায় বইকি! এই চলতি সময়ের হাত থেকে নিজকে একদম সরিয়ে রাখা হয়তো সম্ভব নয়। তবে, বই পড়ার অভ্যাসে মরচে পড়লে, তা ঝেড়ে ফেলে নতুন করে শান দেওয়া যায়। কীভাবে ফেরানো যায় বইয়ে ডুব দেওয়ার সেই পুরনো অভ্যাস? কয়েকটি নিয়ম একটু মেনে চলাই যায়:
:আরও শুনুন:
কলকাতায় শুরু বইপার্বণ, অন্য দেশের বইমেলায় থিম কান্ট্রি হচ্ছে ভারত
দিনের শুরুতেই ঠিক করে নেওয়া যায় যে, এই বইটি পড়তে হবে। দরকার হলে সকালে বালিশের পাশেই বইটি রেখে দেওয়া যায়। এ আসলে নিজের কাছে দেওয়া এক রকম প্রতিশ্রুতি। সারা দিনের কাজের শেষে ফিরে যখন অন্যান্য কাজে ব্যস্ত হয়ে যাওয়া দস্তুর হয়ে উঠেছে, তখন রেখে যাওয়া বই সেই প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দিতে পারে। ফলত স্ক্রিনটাইম খানিক কমতে পারে। আর বইপোকা মাত্রই জানেন যে, একবার পছন্দের বইয়ে ডুবে গেলে আর অন্য কিছুর খেয়াল থাকে না। তাহলে দরকার শুধু অন্য সব কিছু থেকে মনকে বইয়ে ফিরিয়ে আনা। সকালের রুটিনেই তা ঠিক করে ফেলা মন্দ নয়।
বই পড়া বা বই চর্চার একটা সামগ্রিক পরিবেশ তৈরি করতে পারলেও ভালো হয়। সারা দিন কাজের বাইরে আমরা বন্দবান্ধবদের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলি। সেই কথার মধ্যে থাকুক, বই নিয়ে আলোচনাও। তাতে নতুন বইয়ের খোঁজ মিলবে। ঠিক যেভাবে আমরা সিনেমা বা সিরিজের খোঁজ পাই, এই পদ্ধতিও একই রকম। আর বই নিয়ে আলোচনা চলতে থাকলে, বই পড়ার ইচ্ছেও বাড়বে।
সবার যে সব বই পড়তে ভালো লাগবে, তার কোনও মানে নেই। নিজের পছন্দের বিষয় তাই ভালো করে বোঝা উচিত। অন্য অনেকে একটি বই নিয়ে হইচই করছে বলেই যে সে বইটি পড়তে হবে, এমনটা মনে হওয়া আবার বাঞ্ছনীয় নয়। বরং নিজের কোন বইটি পড়তে ইচ্ছে করছে, সেটি হাতে তুলে নেওয়া জরুরি। আর কে না জানে, পছন্দের জিনিস পেলে মানুষ সহজে তাকে ছাড়তে চায় না। বইও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়।
ডিজিটাল পৃথিবী আমাদের অহরহ অন্যত্র ব্যস্ত করে রাখে। সেই ডিজিটাল দুনিয়াকেই বই পড়ার কাজে লাগানো যায়। বই পড়ার অনেক অ্যাপ আছে। মোবাইল ফোনে তাঁদের একেবারে সামনে টেনে আনা যায়, অর্থাৎ হোম স্ক্রিনেই রাখা যায়। অর্থাৎ যখন অন্য অ্যাপের দিকে মন যাচ্ছে, তখন যেন চোখে পড়ে যে বই পড়ার অ্যাপটিও পাশে আছে। ডিজিটালের জন্য বরাদ্দের সময় পড়ার জন্যও থাকুক, মাধ্যমটি তাতে বদলাবে বটে। তবে পড়ার অভ্যাস বজায় থাকবে।
বই পড়ার একটা নির্দিষ্ট জায়গা যদি থাকে, তবে তার থেকে ভালো আর কিছু হয় না। নিজের বাড়িতে যদি সেরকম একটা জায়গা নির্দিষ্ট করা যায়, তাহলে বইয়ে মন দিতে সুবিধা হয়। যদি একান্ত কাজের চাপে বই পড়া না হয়ে ওঠে, তা সত্ত্বেও অন্তত একটা পাতা হলেও পড়া উচিত। ছেড়ে যাওয়া বই হাতছানি দেয়। বইপ্রেমী সেই হাতছানি উপেক্ষা করতে পারেন না।
মোট কথা, বই পড়তে আমরা ভালোবাসি। তাই বইমেলা নিয়ে এত উৎসাহ। এত কেনাকাটা। তবে নানা কারণে মন খানিক বইবিমুখ যে হয়ে ওঠে, তা অস্বীকার করা যায় না। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সেই মনকে একটু জড়ো করতে পারলেই বইয়ের পাতায় ফেরা আর তেমন কষ্টের কিছু হয়ে ওঠে না। বইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়েও তাহলে আর দুশ্চিন্তার কিছু থাকে না।