বাহন বাঘ। তাও আবার এক জোড়া। একই চালায় তিন দেবী। তিনজনের হাতেই বীণা। এই গ্রামের সরস্বতী মূর্তির এমনটাই বিশেষত্ব। পাশাপাশি পুজোয় ধরা পড়ে সম্প্রীতির ছবি। বিসর্জনের আগে স্থানীয় মাজারে চড়ানো হয় সিন্নি। কোথায় রয়েছে এমন গ্রাম?
দেবী শ্বেতপদ্মের আসনে অধিষ্ঠিতা। শ্বেত পুষ্পেপশোভিতা। শ্বেতশুভ্র রাজহংস তাঁর বাহন। একহাতে বীণা এবং অপর হাতে বেদ ধারণ করেন। জ্ঞান, বোধ, বিদ্যা, বুদ্ধির নিয়ন্ত্রক। তাঁকে স্মরণ করেই মুর্খ কালিদাস হয়েছিলেন পণ্ডিত। সেই দেবীর সামনে একজোড়া বাঘ!
শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সরস্বতীও থিমের জালে জর্জরিত। শ্বেতবসন ছেড়ে দেবীকে পরতে হচ্ছে বাহারি রঙের কাপড়। কখনও আবার পোশাকেও বৈচিত্র ধরা পড়ছে থিমের ঠাকুরে। বীণার বদলে গিটার, হাঁসের আদলে স্কুটি, সবই হচ্ছে হাল ফিলের শহুরে পুজোয়। কিন্তু এক্ষেত্রে যে পুজোর কথা বলছি, তা মোটেও শহরের পুজো নয়। সাবেকী প্রতিমা, ডাকের সাজ সবই ধরা পড়ে এই মূর্তিতে। সময়ের হিসাবেও এই পুজোর বয়স ভালোই। বেমানান বলতে দেবী মূর্তির সামনে একজোড়া বাঘ। আকারে ছোট, তবে ডোরাকাটা কালো-হলুদ রয়্যাল বেঙ্গলই বটে।। অনেকটা সুন্দরবনের বনবিবির থানে যে বাহন দেখা যায় তার মতো। একথা শুনে মনে হতেই পারে, এই পুজো সুন্দরবনের কোনও অখ্যাত গ্রামের পুজো। স্থানীয় দেবীর সঙ্গে মিল রেখেই সরস্বতীর ওমন বাহন। কিন্তু আদতে এই পুজো সুন্দরবনের নয়। বরং তার থেকে অনেকটাই দূরে, বীরভূমের দুবরাজপুরে। সেখানকার খোসনগর গ্রাম সরস্বতী পুজোর জন্য বিখ্যাত। তবে সংখ্যায় অনেক পুজো সেখানে হয় না। একটিই জমিদার বাড়ির পুজো, যেখানে বিশেষ ধাঁচের সরস্বতী মূর্তি দেখা যায়।
:আরও শুনুন: তিনি দেবী, আবার নদীও… এককালে কৃষির দেবী হিসেবেও পূজা পেতেন সরস্বতী
এমনিতে মূর্তির গঠন আলাদা নয়। গড়ন অনেকটা দেবী দুর্গার মতো। তবে এক্ষেত্রে একচালের মধ্যমণি সরস্বতী। দুই পাশে দেবী লক্ষ্মী ও রাজলক্ষ্মী। তিনজনের হাতেই বীণা। চারপাশে সখীদের মূর্তি রয়েছে, তবে আকারে ছোট। সবথেকে অবাক করে দেবীর সামনে থাকা দুটি বাঘের মূর্তি। আর কোনও সরস্বতী মূর্তিতে এমন বাহন দেখা যায় না। তবে দুবরাজপুরের এই পুজোয় এটাই বিশেষত্ব। পুজো ঘিরে এলাকাবাসীর মধ্যে রীতিমতো উচ্ছ্বাস দেখা যায়। আসলে, এই গ্রামের মাত্র দুটি উৎসবই জনপ্রিয়। একটি মুসলিমদের উরস পরব, অন্যটি সরস্বতী পুজো। প্রথমটি মুসলিমদের উৎসব, কাজেই সেখানে হিন্দুদের আগ্রহ না থাকাটাই স্বাভাবিক। আবার সরস্বতী পুজো নিয়ে মাতামাতি করবেন না এলাকার মুসলিমরা এমনটাও ভেবে নেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু এখানে একেবারেই এমনটা হয় না। বরং দুই উৎসবেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধরা পড়ে। এলাকাবাসীর কথায়, দুই উৎসবের গুরুত্বই তাঁদের কাছে সমান। মুসলিমরা যেমন সরস্বতী পুজোয় অংশ নেন, হিন্দুরাও তেমনই উরস পরবে। স্থানীয় এক মাজারে বসে উরসের আসর। সেখানে দলে দলে ভিড় জমান সবাই।
আরও একটা কারণে এই পুজোকে বিশেষ বলতে হয়। সরস্বতী পুজোর বিসর্জনের আগে মাজারে সিন্নি চড়ানো হয়। বলা হয়, এমনটা না করলে দেবীমূর্তির বিসর্জন করা যাবে না। ঠিক কেন এমন নিয়ম তা জানা গেলেও, দীর্ঘদিন ধরে তা পালিত হয়ে আসছে। সকলেই ভক্তিভরে এই নিয়ম মেনে চলেন। গ্রামের কেউ আপত্তি করেন না। বরং অন্যান্য গ্রামের মানুষ এইসময় খোসনগরে চলে আসেন। পুজো হয় বিশেষ নিয়ম মেনে। এককালে বিশাল মন্দির থাকলেও, বর্তমানে তা ভগ্নপ্রায়। মাজারের অবস্থাও তেমন ভালো নয়। তবে পুজো বা পরবের সময় সবকিছু সুন্দরভাবে সাজানো হয়। সরস্বতী পুজো বিখ্যাত এমন জায়গায় বাংলায় আরও রয়েছে। তবে সেখানে একাধিক পুজো হয়। তার মধ্যে থিমের প্রবেশও ঘটেছে ইতিমধ্যেই। তবে খোসনগরে সে বালাই নেই। সাবেকী প্রতিমায় ভক্তিভরে পুজোর আয়োজন করেন সকলে। এতটুকু খুঁত বা খামতি থাকে না আয়োজনে। বিদ্যার দেবীই তাঁদের কাছে প্রধান। তাই একইসঙ্গে লক্ষ্মী, সরস্বতীর আরাধনায় মাতেন গ্রামবাসী।