রিপোর্ট শুধুমাত্র তথ্যের সমাহার তো নয়। তা আমাদের বেঁচে থাকাকেই যেন অঙ্কের ভাষার প্রকাশ করে। সুতরাং এই রিপোর্ট যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে শোষণের বিশ্বে এই পৃথিবী কীভাবে টিকে আছে। যাঁরা ‘টেকার্স’, ‘মেকার্স’ নন, তাঁদের হাতেই পৃথিবীর কর্তৃত্ব।
ধনকুবেরদের সম্পদ বৃদ্ধি হয়েছে রকেটের গতিতে। অন্যদিকে যাঁরা দরিদ্র, গোটা বিশ্ব জুড়েই তাঁদের পড়তে হয়েছে নানাবিধ সংকটে। স্পষ্ট করে বলতে গেলে, সাম্প্রতিক বিশ্বে অসাম্য বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত। সাম্প্রতিক অক্সফাম রিপোর্টের একেবারে গোড়াতেই তা উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে। আবার এই রিপোর্টের যে নাম দেওয়া হয়েছে, তাতেই যেন মালুম হচ্ছে বিশ্ব-অর্থনীতির সাম্প্রতিক চেহারা। ‘টেকার্স, নট মেকার্স’, অক্সফামের বার্ষিক রিপোর্টের এটিই শিরোনাম। অর্থাৎ যাঁরা গ্রহণ করেছেন, তাঁরা নির্মাণ করেননি কিছুই।
অক্সফাম ইন্টারন্যাশনালের এই রিপোর্টের দিকে তাকিয়ে থাকেন অর্থনীতিবিদরা। সভ্যতা জুড়ে অর্থনীতির বৈষম্য কীভাবে মানুষের ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তারই আভাস মেলে পরিসংখ্যান-খতিয়ানে। এবারের রিপোর্ট বলছে, ২০২৪ সালে গোটা বিশ্বে বিলিওনেয়ারদের সম্পদের মোট পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ লক্ষ কোটি ডলারে। ২০২৩ সালে যা ছিল ১৩ লক্ষ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছরে বৃদ্ধি প্রায় ২ লক্ষ কোটি ডলার। প্রত্যাশিত ভাবেই বেড়েছে বিলিওনেয়ারদের সংখ্যাও। অনুমান করা হয়েছে যে, আগামী দিনে অন্ততত ৫ জন ট্রিলিওনেয়ারের দেখা মিলবে। আর এই নিরিখে দরিদ্র পৃথিবীর কী অবস্থা? প্রায় এক কথায় তার উত্তর দেওয়া যায়। ১৯৯০ থেকে ২০২৪, অর্থাৎ তিন দশকের একটু বেশি সময়ে দরিদ্রের সংখ্যায় বিশেষ কিছু পরিবর্তন হয়নি। বরং যাঁরা দরিদ্র তাঁদের সংকট এখন বহুমাত্রিক। গোটা বিশ্বের অর্থনৈতিক অসাম্যের রূপ যেন এর থেকে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তবে সেই সঙ্গে এই বৈষম্যের আর একটি মাত্রাও স্পষ্ট করেছে অক্সফাম, যা পেশ করা রিপোর্টের শিরোনাম। অর্থাৎ ধনকুবেরদের যে ধনসম্পদ বৃদ্ধি হয়েছে, তা তাঁদের নির্মাণের কারণে নয়। তাঁদের ভূমিকা কেবলই গ্রহীতার। ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালে বিলিওনেয়ারদের সম্পদ বৃদ্ধির হার ৩ গুণ। তা এল কীভাবে? অক্সফামের রিপোর্ট মোতাবেক, তা হয় উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া; নয়তো ক্রোনি-ক্যাপিটালিজমের আশীর্বাদে ফুলে-ফেঁপে ওঠা; এ ছাড়া আছে ক্ষমতার একচেটিয়া আধিপত্য বা মনোপলি তৈরি করে শোষণ। বিস্তারিত তথ্যে না গিয়েও বোঝা যায়, সাম্প্রতিক পৃথিবীতে ধনী-দরিদ্রের ফারাক যে শুধু বেড়েছে তা নয়, বরং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শোষণ একটি অন্য রূপ নিয়েছে। পৃথিবীর সম্পদ কুক্ষিগত হচ্ছে মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে। যা আবার প্রভাবিত করছে রাজনীতিকে, সেই সূত্রে সাম্প্রতিক ইতিহাসকেও।
আর এই সূত্রেই চলে আসে উপনিবেশের আলোচনাও। এক কালে কলোনি স্থাপন করে যে অবাধ লুটতরাজ চলত, ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেয়। সেই পর্ব কি ফুরিয়ে গিয়েছে? আপাত ভাবে তা মনে হতে পারে। তবে, অক্সফামের রিপোর্ট বলছে, অর্থনৈতিক শোষণের যে মাত্রা বর্তমান বিশ্বে, তাতে ঔপনিবেশিকতাবাদ যেন নতুন রূপ পেয়েছে। আর তার দরুনই দরিদ্র পৃথিবীর অবস্থা গত তিন দশকে সামান্যতমও বদলায়নি। বরং নতুন নতুন সংকটে জর্জর হয়েছে সাধারণ মানুষের জীবন।
রিপোর্ট শুধুমাত্র তথ্যের সমাহার তো নয়। তা আমাদের বেঁচে থাকাকেই যেন অঙ্কের ভাষার প্রকাশ করে। সুতরাং এই রিপোর্ট যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে শোষণের বিশ্বে এই পৃথিবী কীভাবে টিকে আছে। যাঁরা ‘টেকার্স’, ‘মেকার্স’ নন, তাঁদের হাতেই পৃথিবীর কর্তৃত্ব। সেই কর্তৃত্ববাদী পৃথিবীতে মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো আদৌ টিকে থাকবে? ইতিহাস যেন আজ সেই পরীক্ষাতেই নেমেছে।