মন্টো অতএব সেই ঝড়ের রাত, যে রাতে আমাদের সাজানো ঘর ভেঙে পড়ে। অথচ সেই ঝড়ের রাতের অভিসারই আমাদের গন্তব্য, আমাদের অভীষ্ট। সময়ের মায়াহরিণ যত ছলনাই করুক, আমরা ক্রমে ক্রমে বুঝি আমাদের গন্তব্য এক মুক্ত দর্শনে- মন্টোইয়াতে।
বেশিদিন আগের কথা নয়। নয়াদিল্লিতে হচ্ছিল মান্টোর নাটক। ‘কালি সালোয়ার’-এর অভিনয় দেখতে এসেছিলেন দীক্ষিত দর্শক। নাটক যখন এগোল, এবং বিশেষ মুহূর্তে পৌঁছল, তখন দর্শকের একজন অস্থির হয়ে উঠলেন। বলে ফেললেন, এ কী অশ্লীলতা! অন্ধকার সেই নাটকঘরে অলক্ষে বসে সেদিন বোধহয় মুচকিই হেসেছিল সদত হসন মন্টো। মন্টো তো মিলিয়ে যেতে পারেন না। তাঁর শেষ বলে কিছু নেই। বরং প্রথামাফিক যেখানে তিনি শেষ করেছিলেন, সেখান থেকেই যেন তাঁর নতুন করে ছড়িয়ে পড়া। অতএব ২০২৪ সালে এসে যখন তাঁর নাটক অস্থির করে তুলল নাট্যপ্রেমী দর্শককে তখন হেসে ওঠা ছাড়া আর কী-ই বা তিনি করতে পারেন! জীবনে বারবার অশ্লীলতার দায়ে কাঠগড়ায় ওঠা মন্টো বোধহয় জানতেন, এই তীব্র অথচ জরুরি অস্বস্তিটুকুই উত্তরকালের দিকে তাঁর নিক্ষিপ্ত বর্শা। আর সংবাদমাধ্যমে এ খবর পড়তে পড়তে মনে হয়, কী যত্ন আর দরদ দিয়েই মান্টো রচনা করেছিলেন তাঁর চাবুক। যে-চাবুক আমাদের সুস্থিতি দেয় না, এক মুহূর্তের জন্যেও না।
প্রথাসিদ্ধ ভঙ্গিমায় মন্টোকে নানা ছকে বেঁধে ফেলা যায়। সে চেষ্টা যতবার হয়, ততবার যেন মন্টো তা থেকে বেরিয়ে যান। আর সময় যত এগোয় দেখা যায়, মন্টো নিজেই এক বিশেষ ভঙ্গিমা হয়ে উঠছেন। মনে পড়তে পারে তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি। যে, তাঁর গল্পকে যদি অসহ মনে হয়, তাহলে বুঝতে হবে যে সময়ের সুড়ঙ্গে আমাদের বাস, সেই সময়টিই অসহ। এখন এই অসহ ভার থেকে আমাদের মুক্তি কীসে? ছাপোষা আমরা অনেকেই পালাবার পথ খুঁজি। বুঝে নিই এসকেপ রুট। মন্টো হাঁটেন ঠিক তার উলটো পথে। জীবনের এই কর্কশ, হিংস্রতার মুখোমুখি দাঁড়ান আর দাঁড় করিয়ে দেন। এই বাস্তবের সঙ্গে শুধু পরিচয় করে দিয়েই ক্ষান্ত হন না। সেই বাস্তবতার ভিতর এমন করে বর্তমানকে টেনে নেন, যে পাঠক-দর্শক যেন আয়নার মুখোমুখিই এসে দাঁড়ান। তখন সেই বাস্তবের বেঁধা কাচ রক্তাক্ত করে। রাগ হয় মন্টোর উপর। কিন্তু মন্টো ছাড়া কে আর সত্যের এত কাছাকাছি, বাস্তবতার নুনছাল ওঠা জ্বালা ধরানো অনুভূতির কাছে পৌঁছে দিতে পারেন! ক্রমে যেন বোঝা যায়, মন্টো আমাদের ভেঙেচুরে নতুন করে গড়ে নিতে চাইছেন। সেই ভাঙচুর অন্তরে, অন্দরে। অতএব মন্টোর মুখোমুখি হওয়া আদতে সেই পবিত্র মুহূর্ত, যখন আয়নার সামনে দাঁড়াতে অস্বীকার করে না মানুষ।
মন্টো আদালতে দাঁড়িয়ে সওয়ালে যা বলেছিলেন, কেউ খারাপ দেখতে বলে আয়নায় তাকাতে অস্বীকার করলে লেখকের কিছু করার থাকে না। এই নগ্নতার মুখোমুখি হওয়ার নামই মন্টো। আমাদের আত্মপ্রবঞ্চনা ধরা পড়ে যাওয়ার নামই মন্টো। না তাঁর লেখায়, না তাঁর জীবনে- কোথাও তিনি একমুহূর্তের সুস্থিতি দেন না। সারাক্ষণ আমাদের ফালাফালা করেন, আমাদের বোধ আর বিবেকের কাছে আমাদের হিপোক্র্যাসি আর ফ্যালাসিগুলোর বোতাম খুলে দিয়ে গুঁড়োগুঁড়ো করে দেন আমাদের জীবনের শান্তিবিলাস। আসলে মন্টো তো সেইরকম যন্ত্রণার রক্তক্ষরণ যার উপর নান্দনিক পর্দা টানা যেমন অসম্ভব, তেমন অযৌক্তিক।
নন্দিতা দাস বছর কয়েক আগে মন্টোকে ফিরিয়ে আনলেন সিনেমার পর্দায়। এমন সময়ে, যখন বিশ্বায়ন-পরবর্তী সময়ে আত্মা থেকে আমাদের দূরত্ব অনতিক্রম্য হয়ে উঠেছে প্রায়। নন্দিতার মন্টো-চর্চা অবশ্য শুধু সিনেমার চিত্রনাট্যে আটকে থাকেনি। তিনি বললেন, তাঁর কাজ যেন হচ্ছে ‘মন্টোইয়াত’ ছড়িয়ে দেওয়া। মন্টো তাঁর কাছে কেবল একজন কথাকার নন। ব্যক্তি তো ননই। বরং তিনি আসলে একটি ভাবনা, আইডিয়া। যে আইডিয়া আমাদের সাহসী হতে বলে; বলে সৎ আর সত্যির কাছে পৌঁছনোর কথা; যে আইডিয়া নির্মোক ছেড়ে আমাদের আত্মমুক্তির দিকে এগিয়ে দেয় তাই-ই মন্টোইয়াত। নন্দিতা সার্থক ভাবেই এই একটি শব্দেই যেন মন্টোর দর্শনের কাছে পৌঁছে যান। ঐতিহাসিকতার সূত্রে মন্টোর কাহিনি বিশ্লেষণ বা মিলিয়ে দেখা এক রকমের জরুরি পদ্ধতি বটে। তবে, তাই-ই মন্টো অনুধাবনের একমাত্র পথ নয়। সুতরাং সময়ের অক্ষে মেলে আমরা মন্টোর দর্শনকেই মিলিয়ে নিতে পারি। আর যতবার তা করা হয়, ততবার যেন নিজেদের কাছেই ধরা পড়ে যাই আমরা। ধরা পরে যায় আমাদের ভণিতা, আত্মপ্রবঞ্চনা। আর তাই এত বছর পেরিয়ে এসেও মন্টোকে আমরা সহ্য করতে পারি না। তাঁর কাহিনি অশ্লীল মনে হয়।
মন্টো অতএব সেই ঝড়ের রাত, যে রাতে আমাদের সাজানো ঘর ভেঙে পড়ে। অথচ সেই ঝড়ের রাতের অভিসারই আমাদের গন্তব্য, আমাদের অভীষ্ট। সময়ের মায়াহরিণ যত ছলনাই করুক, আমরা ক্রমে ক্রমে বুঝি আমাদের গন্তব্য এক মুক্ত দর্শনে- মন্টোইয়াতে।