আধুনিক সময়ের পেশাদার মানুষরাও কুম্ভে শামিল হয়েছেন। আধুনিক জীবনাযাত্রা, বৈভব-বিলাসের সমস্ত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তাঁরা সেই পথ প্রত্যাখ্যান করেছেন। বেছে নিয়েছেন মহাজ্ঞান সন্ধানের রাস্তা, আর তাই এসেছেন অমৃতকুম্ভের সন্ধানে। সুতরাং দেশের যে দর্শন এবং ঐতিহ্য তার সঙ্গে যে আধুনিকতার বিরোধ নেই, তা যেন ক্রমশ প্রকাশ হচ্ছে তাঁদের সিদ্ধান্তে।
কেউ ছিলেন মডেল-অভিনেত্রী। তো কেউ ইঞ্জিনিয়ার। কিংবা কেউ আইআইটি থেকে পড়াশোনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে সাম্প্রতিক যোগসূত্র একটিই। মহাকুম্ভ। মিলনমেলা যেমন ঐতিহ্যের, তেমনই আধুনিকতার। আর আধুনিক পেশাদাররা সেখানে শামিল হয়েই যেন বুঝিয়ে দিচ্ছেন মহামিলনের পরিধি প্রসারিত হয়েছে আরও অনেকখানি।
কুম্ভ কেন মিলনমেলা? সনাতনীদের অংশগ্রহণেই রাখা আছে সেই আভাস। নানা আখড়া থেকে নানা মত ও সম্প্রদায়ের সাধক সেখানে অংশ নেন। শৈব আখড়া, বৈষ্ণব আখড়া এবং উদাসীন আখড়ার সাধকদের এমন সমাগম কুম্ভ ছাড়া আর কোথাও সচরাচর চোখে পড়ে না। ভারতীয় সাধনা এই বহুমতকেই লালন করে। ‘যত মত তত পথ’-ই যেন ঈশ্বর সাধনার মূলমন্ত্র। কুম্ভ তার সার্থক উদাহরণ। উপাসনার নিরিখে একে অন্যের সঙ্গে আলাদা হতে পারেন। তবে যে শাশ্বত ধর্মবোধের উদ্দেশে সকলের অভিযাত্রা, তা যেন শেষ পর্যন্ত কোথাও গিয়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সব পথ এসে কোথাও যেন মিলে যায় শেষে। এ শুধু কাব্যিক ব্যাখ্যা নয়। কুম্ভের মিলনমেলা আদতে বাস্তব করে তোলে সেই কাব্যিক ব্যঞ্জনা, আক্ষরিক ভাবেই। এবং এই মিলনের কথা ভারতবর্ষের আত্মার বাণীও বটে। মত, আচারের পার্থক্য সত্ত্বেও সকল ভারতীয় এক অখণ্ড ভারতীয়ত্বের বোধে জারিত। এরও সার্থক উদাহরণ কুম্ভে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মানুষ যখন একটি পুণ্যভূমে সমবেত হন, তখন সেই মহামিলনের তীর্থক্ষেত্র যেন ভারতবর্ষেরই রূপ তুলে ধরে সকলের সামনে। মিলনের এই মাহাত্ম্যেই কুম্ভ হয়ে ওঠে মহাকুম্ভ।
আরও শুনুন: মহাকুম্ভের শ্রবণ কুমার! মৃতা মাকে মহাস্নান উপহার সন্তানের, কুম্ভে কেবলই দৃশ্যের জন্ম
সেই সূত্রটি যেন এবছর আরও একটি প্রসারিত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, আধুনিক সময়ের পেশাদার মানুষরাও কুম্ভে শামিল হয়েছেন। আধুনিক জীবনাযাত্রা, বৈভব-বিলাসের সমস্ত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তাঁরা সেই পথ প্রত্যাখ্যান করেছেন। বেছে নিয়েছেন মহাজ্ঞান সন্ধানের রাস্তা, আর তাই এসেছেন অমৃতকুম্ভের সন্ধানে। সুতরাং দেশের যে দর্শন এবং ঐতিহ্য তার সঙ্গে যে আধুনিকতার বিরোধ নেই, তা যেন ক্রমশ প্রকাশ হচ্ছে তাঁদের সিদ্ধান্তে। আইআইটি বোম্বে থেকে এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করা অভয় সিং তথা মাসানি গোরখ তাই যেমন এসেছেন, এসেছেন আইআইটি দিল্লির আচার্য প্রশান্ত। আবার এসেছেন এককালের মডেল-অভিনেত্রী হর্ষা রিচারিয়া। মুখে মুখে তাঁদের কারও পরিচিতি ইঞ্জিনিয়ার বাবা, কারও বা অন্য কিছু। তবে তাঁরা সকলেই একটি কথা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, দেশের যে অধ্যাত্মসাধনা তা আধুনিক জীবনের সঙ্গেও মিলেমিশে থাকতে পারে। ঘটাতে পারে মেলবন্ধন। বরং বলা যায়, আধুনিকতার যে ক্লান্তি তা থেকে মুক্তির হদিশ দিতে পারে চিরায়ত ধর্মবোধ। এই ব্যক্তিরা বরং প্রমাণ করছেন যে, ধর্মবোধ আধুনিক জীবনকে সমৃদ্ধি দিতে পারে। বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্তি দিয়ে জীবনে স্থায়িত্ব এনে দিতে পারে। এই যে উপলব্ধিতে পৌঁছে দিচ্ছে কুম্ভ, তা যে আদতে ঐতিহ্য আর আধুনিকতারই মিলন। কুম্ভ তাই নানা মাত্রা স্পর্শ করেই হয়ে উঠছে মহাকুম্ভ।