ইরফান এমন একজন ব্যক্তিত্ব, মৃত্যুর শীত যাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। তিনি নেই, সেটা বোধহয় কেউই মেনে নিতে চান না। ইচ্ছে করেই। তিনি আছেন। যেমন ছিলেন ইরফান খান। নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেতারের মতো। সুমন কল্যাণপুরের গানের মতো। যেমন ছিলেন ইরফান খান মতি নন্দীর গল্প কিংবা গুলজারের ত্রিবেণীর মতো। নক্ষত্রমণ্ডলের শাসনের উলটোদিকে তিনি যেন শারদ আকাশের শুকতারা।
তরুণ সহ-অভিনেতা তাঁর কথা শুনে একটু অবাকই হলেন। উলটোদিকের মানুষটি যে স্বয়ং ইরফান খান। আর যে কথা তিনি বলছেন তা তো নিছক শখ নয়। ঠিক যেন সিনেমার মতো। একটা আশ্চর্য স্বপ্ন। ইরফান বললেন, ‘এক কাজ করা যাক বাইকে করে সীমান্ত অব্দি যাওয়া যাক।’ সহ-অভিনেতার চোখে প্রশ্ন, তারপর? ইরফান যেন তাঁর সমুদ্রগভীর চোখে ঢেউ খেলিয়েই জানালেন সেই স্বপ্নের কথা- একটা ঘুড়ি উড়িয়ে দেব। সীমান্ত পেরিয়ে আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে সেই ঘুড়ি। দেখি, কে আগে গুলি করে! সীমান্তের কাছাকাছিই তখন শুটিং চলছিল ‘দ্য সং অফ দ্য স্করপিওনস্’ ছবির। সেখানেই এমন এক স্বপ্নের কথা জানিয়েছিলেন ইরফান। সে-কথা মনে পড়লে এখনও চোখ যেন করকর করে ওঠে তরুণ অভিনেতা শশাঙ্ক অরোরার। আমাদেরও করে নাকি!
আসলে ইরফান এমন একজন ব্যক্তিত্ব, মৃত্যুর শীত যাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। তিনি নেই, সেটা বোধহয় কেউই মেনে নিতে চান না। ইচ্ছে করেই। তিনি আছেন। যেমন ছিলেন ইরফান খান। নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেতারের মতো। সুমন কল্যাণপুরের গানের মতো। যেমন ছিলেন ইরফান খান মতি নন্দীর গল্প কিংবা গুলজারের ত্রিবেণীর মতো। নক্ষত্রমণ্ডলের শাসনের উলটোদিকে তিনি যেন শারদ আকাশের শুকতারা। দূরের বলেই কাছের। তার কাছে রাখা আছে আমাদের কামনার ঠিকানা। আমরা জানি, সে কথা জানিবে না কেউ আর! তিনি ডায়েরির ভাঁজে তুলে রাখা যেন এক না-পাঠানো প্রেমপত্র।
আরও শুনুন: মধ্যবিত্ত ক্লান্তির জীবন উড়ান পেত যে আশ্চর্য ডানায়, সেই ডানার মানুষ ইরফান খান
ইরফান খানের নক্ষত্রবাসনা ছিল কি-না, তা আমাদের জানা নেই। জানার দরকারও নেই। বিশ্বায়ন যে সুখবিলাসের মরিচীকা উপহার দিল, তাতে আমাদের আর ব্যক্তিগত ঈশ্বর বলে আর সেভাবে কেউ থাকলেন না। যাঁরা থাকলেন, তাঁরা মহিমাময় অবতার। তাঁদের ত্বকে নেই স্বেদ, তাঁদের ছায়া পড়ে না ধুলোয়। সেই অলীক দেবালয়ের দিকে নশ্বর মানুষ যেন তাকিয়ে থাকে তীর্থ অভিলাষে। তবু তার স্নান সম্পূর্ণ হয় না। এদিকে কারুবাসনা শান্তি দিল না ইরফানকে। তাঁকে তাই হাজির হতেই হত পর্দায়। এলোমেলো একজন মানুষ। উসখো-খুসকো একজন মানুষ। যাঁর অপরিপাট্যের মধ্যেও চমৎকার মাত্রাবৃত্ত। তিনি হাসেন, যে হাসিতে লেগে থাকে মধ্যবিত্তের অন্তরের প্রার্থিত নির্মলতা। সুখের অসুখ পেরিয়ে ইরফানের মধ্যে তাই অনেকেই যেন পেয়ে গেলেন সেই পথ, গলি-রাজপথের দ্বৈত থেকে যা বেরিয়ে যেতে পারে অনায়াসে। যা লোকায়ত, অলৌকিক নয়। এমন মায়াপথেই তো জীবন হেঁটে হাসে হাজার বছর, তারপর খুঁজে নেয় দু’দণ্ড মুখোমুখি বসিবার অবসর। ইরফানের অতলস্পর্শী দু’চোখে এসে তাই যেন থেমে যায় আমাদের ক্লান্ত ডানার উড়ান। উপশম আসে। আর ইরফান খান হয়ে যান, আমাদের ছন্দের হিসাব না মেলা চলতি হাওয়ার দু’চার পঙক্তি।
আজ হয়তো অভিনয়শিক্ষার ক্লাস খুঁটিয়ে দেখবে, কী করে একটি চরিত্রের ভিতর রক্তমাংস এনে দিতেন তিনি। প্রায় কীর্তনের মাতনের মতোই একটি চরিত্রের ভিতর এনে দিতেন ঘোর। যে ঘোর থেকে বেরোনো যায় না কিছুতেই। তা কি সংলাপ বলার ধরনে, অভিব্যক্তিতে! তা কি শরীরী অভিনয়ে, নাকি অন্য কিছু! ব্যাকরণ নিশ্চিতই চলবে তার নিজস্ব চলনে। আর সেই চলনের পাশাপাশি কোথাও থেকে যায় জীবনের রবিশস্য। ইরফান খান সেই আশ্চর্য মানুষ, যিনি জীবনের আর একটু প্রাণ সঞ্চার করতে জানতেন। তাই বুঝি অভিনেতা শব্দের ঘেরাটোপ থেকে তিনি কবেই বেরিয়ে গিয়েছেন। বের করে দিয়েছেন আমাদেরও। জীবনের অভিনয় থেকে তিনি আমাদের এনে দাঁড় করিয়েছেন জীবনের নোনা সমুদ্রে। বুঝিয়েছেন, তাতেও মাধুর্য কম নয়।
সুখরতির এই যন্ত্রণাজীবনে তিনি সেই নগরবাউল, যাঁর কাছে মুক্তি রাখা আছে। আমরা কী করেই বা ভাবতে পারি, তিনি নেই! ভাববই বা কেন!