সম্পর্ক-প্রেমের মতো বিষয়ে যখন নিয়মের রোলার চালানো জরুরি হয়ে পড়ে, তখন যেন আঁচ পাওয়া যায়, প্রগতির জানালাগুলোও কোথাও যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ওয়ো-র সিদ্ধান্ত তাই যত না সংস্থাগত পরিবর্তন, তার থেকেও বেশি সামাজিক পরিবর্তনকেই চিহ্নিত করছে।
ওয়ো, পোশাকি অর্থে যা কিনা ট্রাভেল বুকিং প্ল্যাটফর্ম, কাপল-ফ্রেন্ডলি হিসাবেই এর সুনাম। নিন্দুকে বলে থাকেন, কিঞ্চিৎ বদনামও নাকি আছে! নতুন বছরে এবার সংস্থার ভোলবদল। ফ্যামিলি-ফ্রেন্ডলি হিসাবে নয়া যাত্রা শুরু সংস্থাটির। আর সেই হেতু এসেছে ফরমান। বুকিং-এর আগে দেখাতে হবে সম্পর্কের বৈধ প্রমাণপত্র।
একটি সংস্থা তার খোলনলচে বদলে ফেলতেই পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ আসলে রিব্র্যান্ডিং। এতদিনে যে ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে তা ধীরে ধীরে বদলের পক্ষপাতী কর্তাব্যক্তিরা। এই ভাবমূর্তি তৈরির ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়ার বেশ বড় ভূমিকা আছে। মিমের দৌলতে সংস্থার যে ইমেজ তৈরি হয়েছে, তথ্য তা সমর্থন করছে না। সংস্থার কর্তব্যক্তিরা বলছেন, যাঁরা এই সংস্থার পার্টনার হোটেল ব্যবহার করেন, তাঁদের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশই পরিবারের লোকজন, নয় ব্যবসায়ী। অথচ ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে একেবারে আলাদা। সেই জায়গা থেকেই এই কৌশলগত পরিবর্তন। একটি সংস্থার ক্ষেত্রে এই রিব্র্যান্ডিং বা নতুন ইমেজ তৈরির চেষ্টা যেমন নতুন নয়, তেমন সময়ের প্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও বটে। তবে, এই সিদ্ধান্তই এক সামাজিক প্রশ্নেরও জন্ম দিয়েছে। নতুন নিয়মে, অবিবাহিত যুগলদের ক্ষেত্রে এই ধরনের হোটেলের দরজা বন্ধ হতে চলেছে। পালটা পদক্ষেপে তাই সম্পর্কের বৈধ প্রমাণপত্রের উপরও জোর দেওয়া হয়েছে।
প্রশ্ন ঠিক এখানেই। সংস্থা তার মত পরিবর্তন করতেই পারে। তবে, আদতে কাঠগড়ায় উঠছে সেই প্রেম ও সম্পর্ক। বৈধ আর অবৈধর ধারণার উপর জোর পড়ছে সবথেকে বেশি। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, উত্তরপ্রদেশের মিরাট থেকেই এই নতুন নিয়ম চালু করছে সংস্থা। পরবর্তী সময়ে তা হয়তো অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। সেই উত্তরপ্রদেশ, যেখানে ইভ-টিজিং রুখতে চালু হয়েছিল অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াড। উদ্দেশ্য সাধু, সন্দেহ নেই। তবে, ব্যবহারিক ক্ষেত্রে স্কোয়াডের কাজে নীতিপুলিশির অভিযোগই উঠেছিল। যুগলদের দেখলেই যেভাবে স্কোয়াড বৈধ আর অবৈধর ভাগ করায় মনোযোগী হয়, তাতে একজন মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছিল বলেই অনেকে মনে করছিলেন। সংস্কৃতি রক্ষার নামে খানিকটা যে গা-জোয়ারি সংস্কৃতির খবরদারি বাড়ছিল এই স্কোয়াডের দৌলতে, তা একাধিকবার চর্চায় এসেছে। আলোচনা-বিতর্কও হয়েছে তা নিয়ে। লিঙ্গসাম্য আর ব্যক্তির স্বাধীনতা যেখন প্রগতিশীলতার সাধারণ লক্ষণ, তখন এই স্কোয়াডের চলন ঠিক তার বিপরীত দিকে। সেই সঙ্গে সংস্কৃতির একটি একমাত্রিক কাঠামোর উপরই জোর দেওয়া হচ্ছিল, যা এই দেশের বিবিধতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। লাভ জেহাদের অভিযোগ তাই যে ক্রমশ রাজনৈতিক হয়ে উঠছিল, তার একটা পূর্বসূত্র যেন বাঁধা ছিল এখানেই।
এবার বেসরকারি সংস্থা যখন প্রায় একই পথে হাঁটতে চলেছে, তখন যেন সেই নীতিপুলিশি-ই বৈধতা পাচ্ছে প্রকারন্তরে। সংস্থাটির বয়ান এখানে খেয়াল করার মতো। জানানো হয়েছে, ব্যক্তি স্বাধীনতায় পূর্ণ আস্থা রেখেও এই পথ বেছে নিতে হচ্ছে তাদের। স্থানীয় নাগরিক সমাজের প্রতিক্রিয়া ও মতামত এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। মাইক্রো মার্কেটে ব্যবসা চালাতে গেলে এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই যে সংস্থাকে চলতে হবে, তা দ্বিধাহীন ভাবেই স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। নেটদুনিয়ায় অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, যে সংবেদনশীলতার কথা মাথায় রেখে এই পদক্ষেপ, শিশুমৃত্যু বা অন্যান্য বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে তা কোথায় থাকে! কেন বারবার কোপ এসে পড়ে প্রেমে আর সম্পর্কে! তাহলে কি একমাত্রিক সংস্কৃতির আদর্শই মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে বেসরকারি সংস্থাও? সেক্ষেত্রে বলা যায়, নীতিপুলিশি ক্রমশ একটি সার্বজনিক চেহারাই নিচ্ছে। তা কেবলমাত্র একটি অঞ্চলের নিয়মে সীমাবদ্ধ থাকছে না, হয়ে উঠছে গড় একটি অভ্যাস।
পালটা যুক্তি আছে। তা বলছে, যাঁরা এই সংস্থার সঙ্গে সহমত পোষণ করছেন না, তারা এই সংস্থার মাধ্যমে বুকিং করবেন না। তাহলেই ঝামেলা চুকে গেল। তবে, আদৌ গেল কি? একই পথ যে অন্যান্য সংস্থাও নেবে না তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। উপরন্তু যে নাগরিক সমাজের কথা মাথায় রেখে এই সিদ্ধান্ত, তার ভাবনা বদলের তো কোনও আভাস নেই। যা কিছু অবৈধ বা বেআইনি তা নিশ্চিতভাবেই বন্ধ হওয়া উচিত। তবে, সম্পর্ক-প্রেমের মতো বিষয়ে যখন নিয়মের রোলার চালানো জরুরি হয়ে পড়ে, তখন যেন আঁচ পাওয়া যায়, প্রগতির জানালাগুলোও কোথাও যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ওয়ো-র সিদ্ধান্ত তাই যত না সংস্থাগত পরিবর্তন, তার থেকেও বেশি সামাজিক পরিবর্তনকেই চিহ্নিত করছে। আর সেই পরিবর্তন সদর্থক কি-না, সে ভাবনার অবকাশ কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।