কেবলমাত্র হিন্দুরাই মন্দিরে প্রবেশ করতে পারেন! পুরীর মন্দিরে এমন বিজ্ঞপ্তি যে কারও নজরে পড়বে। কিন্তু ভগবান তো সকলের, তাহলে ভিনধর্মের কেউ কীভাবে জগন্নাথ দর্শন করবেন? সেই উপায় বাতলে দেন স্বয়ং জগন্নাথি। পতিতপাবন রূপে সকলের সামনে বিরাজ করেন প্রভু। কী মাহাত্ম্য এই রূপের? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
দারুব্রহ্ম পুরুষোত্তম শ্রীজগন্নাথ, নীলাচলধামে অনাদিকাল থেকে তিনি লীলায় আলীন। তিনি কোনও নির্দিষ্ট জাতি বা ধর্মের দেবতা নন। তিনি সর্বধর্মের সংমিশ্রণে মানবধর্মের এক অভিন্ন রূপ। তাঁর দর্শন থেকে বঞ্চিত রাখে এমন সাধ্যি কার! পুরীর মন্দিরে প্রভুর পতিতপাবন রূপটি যেন সেই ইঙ্গিতই বহন করে।
লীলাবিলাসে তিনি গনধর্মের গণদেবতা। কখনও কালী, কখনও শিব আবার কখনও গণেশ রূপে তাঁর প্রকাশ। কথিত আছে, ভক্ত তাঁকে যে রূপে কল্পনা করবে, সেই রূপেই ধরা দেবেন প্রভু জগন্নাথ। তবে প্রতিটি মন্দিরের কিছু নিজস্ব নিয়ম থাকে। শ্রীক্ষেত্রও ব্যতিক্রম নয়। বরং দেশের অন্যান্য মন্দিরের তুলনায় এখানে নিয়মের বেড়াজাল অনেকটাই বিস্তৃত। আর সেই প্রসঙ্গেই জগন্নাথের পতিপাবন লীলাটি বর্ণনা করা যায়। পুরীর মন্দিরের চারটি দুয়ার। তার মধ্যে প্রধান হিসেবে মান্যতা পায় ‘সিংহদুয়ার’। এই দরজার ঠিক পাশেই রয়েছে প্রভুর একটি মূর্তি। আকারে আসল বিগ্রহের মতো বড় নয়। রয়েছেন স্রেফ জগন্নাথই। তবে এই মূর্তি অনেকটা দূর থেকেই দেখা যায়। তার জন্য মন্দিরে প্রবেশের প্রয়োজন নেই। দূর থেকেই দেখা যায় জগন্নাথকে। শোনা যায় প্রভুর ইচ্ছাতেই এই স্থানে মূর্তি স্থাপন হয়েছিল। যার নেপথ্যে রয়েছে প্রচলিত এক কাহিনিও। কেমন সেই কাহিনি?
তাহলে খুলেই বলা যাক! মুঘল আমলে এদেশের বহু হিন্দু মন্দির ধ্বংস হয়েছে। তবে পুরীর মন্দির কোনও আঁচ পড়েনি। কারণটা অবশ্যই ওড়িশার ভক্তকূল! দুহাত দিয়ে প্রভু জগন্নাথ ও শ্রীক্ষেত্র রক্ষা করেছিলেন তাঁরা। তাই বলে কখনও আক্রমণেই চেষ্টা হয়নি? অবশ্যই হয়েছে। এমনই এক কাহিনির সঙ্গে জড়িয়ে প্রভুর পতিপাবন লীলা। সেইসময় ওই অঞ্চলের সুবেদার ছিলেন তাকি খাঁ। দোর্দণ্ডপ্রতাপ মুসলিম শাসকের সঙ্গে উৎকলের রাজা তথা পুরীর মহারাজের তেমন সুসম্পর্ক ছিল না। কোনও এক যুদ্ধে রাজাকে হারিয়ে বন্দীও করে ফেলেন তাকি খাঁ। এরপরের পদক্ষেপ অবশ্যই পুরীর মন্দিরে হামলা হতে পারত। কিন্তু বন্দী থেকেও রাজা তা হতে দেননি। প্রাণপ্রিয় জগন্নাথের মন্দির বাঁচাতে যে কোনও মূল্য চোকাতে রাজি ছিলেন মহারাজ। এমন পরিস্থিতিতে তাকি খাঁ অদ্ভুত এক শর্তের কথা বলেন মহারাজকে। তাঁর দাবি ছিল, সুবেদার কণ্যা রিজিয়াকে বিয়ে করলেই মুক্ত করে দেবেন মহারাজকে। এদিকে তখনকার দিনে ভিনধর্মে বিবাহ মোটেও সহজ ব্যাপার ছিল না। রাজা হলেও সমাজচ্যুত হওয়ার ভয় ছিল। তাও এই শর্ত মানলে তো পুরীর মন্দির রক্ষা পাবে, এই বেশি না ভেবে শর্তে রাজি হন মহারাজ। ধূমধাম করে বিয়ে হয় তাঁর ও রিজিয়ার। এরপর যা আশঙ্কা করা হয়েছিল তাই হল। রাজার মন্দিরে প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হল। এদিকে, রাজার অভ্যেস প্রতিদিন জগন্নাথ দর্শন করে দিন শুরু করা। মাসের পর মাস সেই অভ্যেসে ছেদ পড়তে থাকল। অস্থির রাজা রোজ রাতের অন্ধকারে মন্দিরের দরজায় হাজির হন, আর অঝোরে কাঁদেন। প্রভুর কাছে একবার দর্শনের জন্য মিনতি জানাতে থাকেন। এমনই একদিন রাজা দেখেন মন্দিরের দরজার পাশে স্বয়ং জগন্নাথ দাঁড়িয়ে। প্রভু নিজে এসে ভক্তকে দর্শন দিচ্ছেন। এভাবেই চলতে থাকল জগন্নাথের লীলা। দিনের পর দিন রাজা রাতের অন্ধকার প্রভুর দর্শন সেরে যান। এদিকে মন্দির খুললেই সেবায়েতরা দেখেন দরজার পাশে জগন্নাথের ফুলমালা পড়ে আছে। অথচ প্রতি রাতে মন্দির বন্ধ করার সময় সব পরিস্কার করা হয়। ধীরে ধীরে সবটা বুঝলেন সেবায়েতরা। প্রভু স্বয়ং রাজাকে দর্শন দিতে রত্নসিংহাসন ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন। তাঁদের ভয় হল, পাছে এমনভাবেই একদিন প্রভু মন্দির ছেড়ে চলে যান। তাই বুদ্ধি করে মন্দিরের দরজার পাশেই আলাদা একটি জগন্নাথ মূর্তি এনে রাখা হল। যা বাইরে থেকে অনায়াসে দেখা যায়। এই জগন্নাথের দর্শন করতে পারেন যে কেউ। তা সেই যতই পাপী এবং পতিত হন। তাই এই মূর্তি পতিতপাবন হিসেবে পরিচিত। এখনও পুরীর মন্দিরের সিংহদুয়ারের পাশে এই মূর্তি দেখা যায়। নিয়মিত পূজার্চ্চনা হয় সেখানেও। আর গনধর্মের গণদেবতা হয়ে জগত সংসারকে দর্শন দিয়ে যান প্রভু জগন্নাথ।