শতাব্দীপ্রাচীন এক মেলা সম্পর্কে। ব্রিটিশ আমলে তৈরি সেই মেলাতেই এক হয়েছিল ইন্ডিয়া। অর্থাৎ এক মঞ্চে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বাংলা, বিহার, ওড়িশা, মাদ্রাজ, পাঞ্জাব সহ প্রতিটি রাজ্যের প্রতিনিধিরা। আর কী বিশেষত্ব ছিল এই মেলার? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
লোকসভা ভোটের আগে চর্চায় ছিল জোট। ইন্ডিয়া বনাম এনডিএ। ভোটের পর অবশ্য এদের পরিচয় বদলেছে, ক্ষমতায় NDA, বিরোধী জোট ইন্ডিয়া। তবে লোকসভা ভোটের প্রায় ১০০ বছর আগেও চর্চায় ছিল ইন্ডিয়া। সেখানেও জোট হিসেবেই। তবে রাজনীতির ময়দানে নয়, একতার মঞ্চ হিসেবে।
কথা বলছি শতাব্দীপ্রাচীন এক মেলা সম্পর্কে। ব্রিটিশ আমলে তৈরি এই মেলাতেই এক হয়েছিল ইন্ডিয়া। অর্থাৎ এক মঞ্চে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বাংলা, বিহার, ওড়িশা, মাদ্রাজ, পাঞ্জাব সহ প্রতিটি রাজ্যের প্রতিনিধিরা। পরাধীন ভারতে সবার মধ্যেই একতার মন্ত্র ছড়িয়ে দিতে চাইতেন স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। সেই সুবাদে মেলার আয়োজন হত। স্বদেশী মেলায় মূলত প্রচার চলত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। কীভাবে দেশের মানুষ এক হলে, বিদেশী শক্তি পিছু হটতে বাধ্য হবে, সেই পাঠ দিতেন স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। তবে সবটাই গোপনে। কোনওভাবে সরকার বাহাদুর জানলেই সব শেষ! মেলা তো বন্ধ হবেই, সেইসঙ্গে এই কাজের অপরাধে জুটবে কড়া শাস্তি। কিন্তু যে মেলার কথা বলছি, সেখানে কোনও লুকোছাপা ছিল না। বরং ব্রিটিশ সরকারই এই মেলার জন্য উদ্যোগী হয়েছিল। যদিও একে ঠিক মেলা বলা যায় না, বরং প্রদর্শনী বললেই সঠিক হবে। তবে যেভাবে সেই প্রদর্শনীর আসর বসত, তা মেলার চাইতে কম নয়।
প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা বাজেট ঠিক হয় মেলার। চাঁদা দিয়েছিলেন সেকালের ধনকুবেররা। দেশের সব বিখ্যাত ব্যবসায়ীরাই এই মেলা এবং প্রদর্শনীর জন্য আগ্রহী ছিলেন। কারণ, এই মেলার মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতের নিজস্ব শিল্প, বানিজ্য, কৃষির বিকাশ বিশ্বের দরবারে তুলে ধরা। ব্রিটিশদের আয়োজিত মেলা বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা এসেছিলেন। ঠিক ছিল, এখান থেকে বেশ কিছু ব্যবসায়ী সুযোগ পাবেন বিদেশে গিয়ে নিজেদের পন্য বিক্রি করার। তাই প্রচারের জায়গা হিসেবে এই মেলাকে আদর্শ মনে করেছিলেন সেকালের ব্যবসায়ীরা। কী না ছিল মেলায়! খাবার থেকে শুরু করে জামাকাপড়, প্রসাধনী, হরেক রকমের পন্য দিয়ে সাজানো ছিল এই মেলা। অংশ নিয়েছিল মোট ৪২টি কোম্পানি। টিটাগড় পেপার মিল থেকে স্বরাজ ফ্যাক্টরি সকলেই অংশ নিয়েছিল এই মেলায়। তবে যেহেতু প্রর্দর্শনী, তাই বড় জায়গা না হলে সমস্যা। ঠিক হল ইডেন গার্ডেনসে বসবে আসর। হলও তাই, আজকের যে জায়গায় বিশাল আকারের স্টেডিয়াম সেই মাঠেই বসেছিল এই মেলা। নাম ছিল, ‘ক্যালকাটা একজিবিশন’। ১৯২৩ এর এই মেলা নিয়ে গোটা দেশেই আলোচনা হয়েছিল জোরদার। মেলার অন্তর্গত প্রত্যেকটা স্টলের ডিজাইন অংশগ্রহণকারীরাই করেছিলেন। তবে দায়িত্ব ছিল কনট্রাকটর মেসার্স মার্টিন এন্ড কোং-এর। মেলার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী বাঙালিও। তালিকায় মহারাজা মনীন্দ্রচন্দ্র, বাবু চারুচন্দ্র চ্যাটার্জী, স্যার নীলরতন সরকার, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ প্রমুখের নাম ছিল।
আসলে, এই মেলার প্রধান লক্ষ ছিল আলাদাভাবে বাংলার তথা ভারতের নিজস্ব কিছু পণ্যকে চিহ্নিত করা। যা বিশ্বের বাজারে আলাদাভাবে নিজের জায়গা করে নিতে পারে। এক্ষেত্রে বাংলা বলতে অবিভক্ত বাংলার কথাই বলা হয়েছে। একাধিক সংস্থা যা সেইসময় রীতিমতো নাম করেছিল বিশ্বের দরবারে তাদের পরিচিত হয়ে ওঠার মোক্ষম সুযোগ ছিল এই মেলা। তাই সামগ্রিক ভাবেই ভারতের বিভিন্ন অংশ, বিভিন্ন প্রদেশ নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করেছিল এই মেলায়। তাতে লাভের লাভ অবশ্য খুব একটা হয়নি। কারণ পরবর্তীকালে লন্ডনে আয়োজিত প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল হাতে গোনা কয়েকটি ভারতীয় সংস্থা। তবে এই মেলার মাধ্যমে দেশের একতা নতুন করে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল তা বলাই যায়। বিশেষ করে বিভিন্ন প্রদেশ যেভাবে এক সূত্রে ইন্ডিয়া হয়ে প্রকাশ্যে আসার পণ করেছিল, তা আজও চর্চার বিষয়।