সাংবাদিক হত্যা। নতুন খবর নয়, তবে স্বাভাবিকও নয়। হিসাব বলছে, গত এক বছরে প্রায় ১৮০ জন সাংবিদককে হত্যা করা হয়েছে। তালিকায় ভারতের নামও খুব একটা নীচে নেই। তবে এদেশের সাংবাদিকরা স্রেফ রাজনীতি বা দুর্নীতির কারণে নয়, প্রাণ হারান পরিবেশ রক্ষার স্বার্থেও। কী বলছে সমীক্ষাআ? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
দুর্নীতির তদন্ত শুরু করতেই নিখোঁজ, ট্যাঙ্কের ভিতরে মিলল সাংবাদিকের দেহ। সম্প্রতি এই শিরোনামে ভরেছে ভারতের সংবাদ জগত। তবে এমনটা নতুন কিছু নয়। এর আগেও সত্য উদঘাটনের অপরাধে খুন হতে হয়েছে বহু সাংবাদিককে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে তো বটেই, তালিকায় পাকা জায়গা করেছে ভারতও। সেই স্থান আরও মজবুত করল ছত্তিশগড়ে মুকেশ চন্দ্রকরের হত্যা।
এক্ষেত্রে অবশ্য কারণ সেই দুর্নীতি। শোনা যাচ্ছে, স্থানীয় এক জমির মালিকের দুর্নীতি ফাঁস করেছিলেন মুকেশ। সেই কারণেই অকালে চলে যেতে হল তাঁকে। ঠিক যেভাবে চলে যেতে হয়েছে গৌরী লঙ্কেশ কিংবা জ্যোতির্ময় দে-এর মতো সাংবাদিকদের। তবে ভারতে সাংবাদিক মৃত্যুর কারণ স্রেফ দুর্নীতি নয়। তবে রাজনীতি? নাহ, তাও নয়। বরং মোদি জমানায় সাংবাদিক হত্যার বড় কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে পরিবেশ রক্ষার লড়াই। বিগত দশ বিছর ১৩ জন সাংবাদিকের মৃত্যু হয়েছে পরিবেশ বাঁচানোর তাগিদে। কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজকর্মে পরিবেশের হাল যে আমরা দীর্ঘদিনই বেহাল করে তুলেছি, সে কথা তো আর নতুন নয়। একাধিকবার ভূমিধস, হড়পা বান সে কথা বুঝিয়ে দিয়েছে। অথচ এই পরিবেশ বাঁচানোর লড়াই প্রাণ কেড়েছে এতজন সাংবাদিকের। এদের বেশিরভাগই ছিলেন বিশেষ সংবাদদাতা, অর্থাৎ কারও অধীনে নয়, এরা নিজেরাই তদন্ত করে সত্যি সামনে আনতেন। কখনও বালি মাফিয়া কখনও কৃষি দুর্নীতি এমনকি বেআইনি ভাবে গাছ কাটার প্রতিবাদ জানিয়েও প্রাণ হারাতে হয়েছে অনেককে। তালিকায় অনৈতিক খননকাজও রয়েছে, অর্থাৎ সরকারি অনুমতি ছাড়া চোরাপথে মাটির তলার খনিজ অন্যত্র চালান করার অপরাধ। সূত্রের সুতোয় পা রেখে চলতে চলতে সত্যির অনেকটা কাছে পৌঁছে যেতেন যে সাংবাদিকরা তাঁদেরই হত্যা করা হত নির্মমভাব। বলা ভালো, এখনও সেই হত্যালীলা বন্ধ হয়নি। কীভাবে হত্যা হচ্ছে, সেই ধারণা সিনেমা সিরিজ দেখলেই হতে পারে। কাউকে প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে, কাউকে আবার ভরা রাস্তায় গাড়ি চাপা দিয়ে মারা হয়। তারপর সেই খুনের তদন্ত, শাস্তি সবই হয়, যেটা হয় না তা হল সত্য উদঘাটন। যে কারণে প্রাণ হারাতে হল ওই সাংবাদিককে, সেই কারণের হদিশ পান না কেউই। নতুন করে অনুসন্ধান চালাতে গেলেও বিপদ, যে সেই কাজ করবেন তাঁকেও মৃত্যুবরণ করে নিতে হবে অকালে।
যোগেন্দ্র সিং, কিরণ মিশ্র, সন্দীপ শর্মা, শুভম ত্রিপাটি…নির্ভিক সাংবাদিকের তালিকা একেবারেই ছোট নয়। এরা কেউ উত্তর প্রদেশ, কেউ মধ্য প্রদেশ, কিংবা বিহারের বাসিন্দা ছিলেন। মন দিয়ে নিজেদের কাজটুকু করে যেতেন। এতটুকু দুর্নীতি স্পর্শ করতে দিতেন না কাজের জগতকে। বরং সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে যেভাবে আসর সাজিয়ে বসছে দুর্নীতি, সে কথা সকলকে জানাতে চাইতেন। ব্যক্তিগত প্রতিশোধ নয়, এদের কাছে সত্যি উদঘাটনের স্বার্থ বলতে ছিল পরিবেশ রক্ষা। যাতে আগামী পৃথিবী সুস্থ হয়ে ওঠে। কিন্তু না, সাময়িক স্বার্থসিদ্ধির লোভে কিছু মানুষের মতোন দেখতে পশু এদের হত্যা করেছে। পরিবেশের কথা ভাবলে মুনাফা মিলবে কীভাবে! সেই প্রশ্নের উত্তর ভুল হচ্ছিল এদের কারণেই, তাই পথের কাঁটা সরিয়ে দেওয়া। তাই বলে সাংবাদিকরা থেমে থাকেননি, আগামীতেও থাকবেন না। ছত্তিশগড়ের মুকেশ নিজের জীবন দিয়ে সেকথা প্রমাণ করলেন।
প্রাচীনকালে বলা হত, দূত নাকি অবধ্য। সাংবাদিকদের ক্ষেত্রেও সে কথা খাটে। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে, বিরোধের পটভূমিতে, কিংবা আপন দেশেও সাংবাদিকরাও যে নিরাপদ নন, সে কথা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে আজকের পৃথিবী।