আচার যেন ধারাবাহিক উপন্যাস। চটপটে আনন্দ দেয়, তবে তাকে পেতে গেলে সইতে হয়। একটু দীর্ঘমেয়াদি। কিন্তু ধৈর্য ধরলে মিলবেই। এই আশায় অপেক্ষা করে ছাদের রোদ। অপেক্ষা করে মা-ঠাকুমার আশকারা পাওয়া, তাদের হারিয়ে যাওয়া মাখো মাখো প্রেম।
‘শীতকাতুরে’ সিরিজে ছাদের রোদ আর আচারের প্রেমকাহিনি লিখলেন শুভদীপ রায়।
পড়ে শোনালেন চৈতালী বক্সী, অলংকরণে দীপঙ্কর ভৌমিক।
ধুলো ঝেড়ে বাইরে এসেছে ট্রাঙ্ক। টুপি-মাফলার জোট গড়তে ব্যস্ত। হাফ সোয়েটার আগেই প্রমোশন পেয়েছে, এতদিনে বার দুয়েক অফিস ভ্রমণ কমপ্লিট। গুটি গুটি পায়ে জানলায় হাজির উত্তুরে হাওয়া। যেভাবেই হোক ভিতরে ঢুকবে। লেপ তখনও আড়মোড়া ভেঙে বাইরে আসেনি, শীতের গন্ধ মাখব মাখব করছে। হাওয়ার দাপটে এই সবই এলোমেলো হতে পারত, সহায় জানলা, অভেদ্য দুর্গের মতো উত্তুরে হাওয়াকে আটকেছে। ধাক্কা খেয়ে রকে রকে গুলতানি মারতে বেড়িয়েছে বেয়াড়া হাওয়া। কোনও কথা শোনে না, কোনও নিয়ম মানে না। বেমক্কা সবকিছু এলোমেলো করে দিতে ওস্তাদ। এইসময় পাড়ায় গণ্ডগোল মানে এই হাওয়ারই দোষ। নিশ্চয়ই কারও অনিষ্ট হয়েছে। কিন্তু না, এবার সমস্যাটা অন্য। নতুন নয় যদিও। প্রতিবার শীতের সঙ্গে সঙ্গে উত্তুরে হাওয়ার মতো ওরাও আসে। এমনিতে সব ভালো, শুধু একটা জিনিস ছাড়া। বড্ড মাখোমাখো সবকিছু। পাড়ার একটা কালচার বলে তো ব্যাপার আছে নাকি! সেসব নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই ওদের। প্রেম যেন আর কেউ করে না! এভাবে জড়িয়ে থাকার কি আছে সবসময়? বড্ড চোখে লাগে ওদের মাখামাখিটা। তাই টক-টক গন্ধ, ঝাল-ঝাল কথা আর মিঠে-মিঠে গপ্পো মিশিয়ে ছাদের রোদ আর আচারের প্রেমকাহিনি সবার মুখে মুখে।
এমনিতে পাড়া কালচার ধরে রাখার হোতা মা-ঠাকুরমারা। কোথাও এতটুকু বেচাল দেখলেই শুরু করেন চিৎকার। ওরা না থাকলে হয়তো আদা আর কাঁচকলাও এতদিনে এক হয়ে যেত। কিন্তু এক্ষেত্রে ওদেরও একচোখামি রয়েছে। মানে এই আচার আর রোদকে নিয়েই। মিঠে রোদের একলা ছাদে যখন শুধুমাত্র আচারের দাপট। চুপি চুপি সেখানে হাজির হন ঠাকুরমারা। আলতো করে হাত বুলিয়ে দেন ওদের গায়ে। মনে মনে বলেন ‘তোদের গায়ে হলুদ হোক’! মানছি বিয়ের মরশুম, তাই বলে এমন মাখো মাখো প্রেমকে সপাট স্বীকৃতি! বাকিরা কী শিখবে এর থেকে?
তা যাই শিখুক, মনে মনে বললেই তো আর হল না। উত্তুরে হাওয়ার দাপট আছে, দস্যি ছেলেবেলার আচার চুরি করা হাত আছে, সেসব উপেক্ষা করে প্রেম করা বেশ কঠিন। তবে ইনি আদিম যুগের প্রেমিক! ডিকশনারিতে ডেটিং বলে কিছু নেই। প্রেম বলতে সম্পর্কটাকেই বোঝেন। ঘুরতে যাওয়া, কফি খাওয়া, এসবের প্রয়োজন মনে করেন না। বিশ্বাস করেন অপেক্ষায়। মনে মনে জানেন, সম্পর্ক একদিনে তৈরি হওয়ার জিনিস নয়। সম্পর্ক জারিয়ে জারিয়ে হয়, তারিয়ে তারিয়ে জীবন তার স্বাদ নেয়। এহেন দামাল প্রেমিক রোদ একদিন আচারের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধবে এমনটা সবাই বুঝেছিল। শুধু কবে সেই দিন আসবে তা কেউ জানত না। পথ চেয়ে বসে থাকতেন মা-ঠাকুরমারা। তাঁরা জানতেন, সবুরে মেওয়া ফলে, ধৈর্যে আচার।
তারপর কী যে হল! অপেক্ষার সংজ্ঞাটাই বদলে গেল। পথ চেয়ে থাকা ব্যাপারটা জাস্ট উধাও। চিঠি নেই, চিঠি লেখার মানুষও নেই। শুধু কম্পিটিশন হলেই, সবাই চিঠি লেখে। ভালোবাসা জাহির করে অজানা ঠিকানায়। সেই চিঠি সবাই পড়ে। ভালোবাসা ছাড়া বাকি যা কিছু সেসব নিয়ে গপ্প জোড়ে। একা পড়ে থাকে ডাকঘর। ফাঁকা, শূন্য। এতদিনে নিশ্চয়ই সুধা অমলকে ভুলেছে। অবশ্য উপায়ই বা কী আছে আর! আজকাল তো অনলাইনেই সব মেলে। দই, ফুল সঅঅব… চিঠির প্রয়োজনীয়তা অনায়াসে মেটায় চ্যাটবক্স। তাও মাত্র দেড় সেকেন্ডে! ‘কবে ফিরবে?’ এই প্রশ্নও অতীত। অপেক্ষার দূরত্ব কত, জানিয়ে দেয় জিপিএস। সময় মেপে বলে দিতে পারে ফেরার তারিখ। ‘আচার হবে কতদিনে?’, এই উত্তরও বোধহয় চ্যাটজিপিটি জানে। তাই রোদের রোম্যান্স কারও চোখে পড়ে না। মা-ঠাকুরমার এত আশকারা পেয়েও আচার আর রোদের মাখামাখি সম্পর্কটা ভেঙেছে। অবশ্য এমনটাই তো ট্রেন্ডিং!
এই ট্রেন্ডে গা ভাসিয়েই বাড়ি ভাঙা হয়েছে। পাড়ার নতুন নাম হয়েছে হাউজিং কমপ্লেক্স। সেখানেও ঘটা করে পুজো হয়, খাওয়া-দাওয়া, নাচ-গান, হই-হুল্লোড় সব হয়। স্রেফ মাখামাখি সম্পর্কে না নেই। নিয়ম বলতে, কে লিফট ব্যবহার করতে পারবেন আর কে পারবেন না, সেইসব। সবাই সবার মতো স্বাধীন। দৌড়ানো গণঅভ্যাস। ছাদ আছে, তবে ওঠার অনুমতি নেই। কার মানসিক অবস্থা কেমন সে খোঁজ রাখে না কেউ। যদি কেউ ভুল কিছু করে ফেলে! থানা-পুলিশ…বড্ড হ্যাপা! তাই ছাদে ওঠায় কড়া নিষেধাজ্ঞা। খোলা আকাশের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে হলে এক চিলতে বারান্দা ভরসা হতে পারে। তা সেই জায়গা গাছেদের জন্য বরাদ্দ থাক। পরিবেশ সচেতন না হলে আগামী প্রজন্ম কী শিখবে! এতকিছুর মাঝে রোদের খোঁজ করে লাভ নেই। সম্পর্ক ভাঙার দুঃখে তিনি বেপাত্তা। ঠিক কোথায়, সেই হদিশ জিপিএসে মেলে না। বোধহয় বেপাড়ায়। একা আচার কীই বা করত! সেও বোতলবন্দি হয়েছে। বড় বড় কাচের বয়ামে আয়েস করে বসে থাকা দিন শেষ। ছোট শিশিতে ওজন মেপে থাকতে হয় আজকাল। এক গ্রাম বেশি হলেই বাদ। রোদের ওম গায়ে মাখার সুযোগ নেই। তাই আচার এখন ঠান্ডায় নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে, শপিং মলে।
অনলাইনেও মেলে। মাত্র ১০ মিনিটে হাতেগরম, থুড়ি আচার তো আর পিজ্জা নয়! রোদ যে নেই, সে কথা খেয়াল হয় না কারও স্রেফ এই কারণে। কে এত অপেক্ষা করবে! সময় কোথায়! রোদ আর আচারের মাখোমাখো রোম্যান্স দেখতে গিয়ে যদি অফিস ঢুকতে দেরি হয়! তার চেয়ে অনলাইনে আনিয়ে নেওয়া ঢের ভালো। দেখার প্রয়োজন নেই কীভাবে তৈরি হয়েছে, কে তৈরি করেছে, স্বাদ ভালো হলেই হল। খুব ভালো হলে, রিলস বানানো যেতে পারে! ক্যামেরার সামনে আচারের বোতল রেখে ব্যাকগ্রাউন্ডে বাউল গান। ‘মিলন হবে কতদিনে…’। মানে নেই। থাকার প্রয়োজনও নেই। গান হিট তো রিলও হিট। লাইকের বন্যা। নস্ট্যালজিক ভাইবের আদর। সব মিলবে, মাত্র দশ মিনিটেই। এমন রাতারাতি খ্যাতি কে না চায়! এক্কেবারে ইনস্টান্ট গ্রাটিফিকেশন।
কিন্তু এইভাবে কতদিন? দৌড় শেষে ক্লান্তি আসবেই। তখন ফিরে আসে আচারের কথা। স্বাদের নয়, ধৈর্যের খোঁজে। রিলস, সিরিজ, বিঞ্জ ওয়াচের দুনিয়া থেকে সাময়িক বিরতি। ক্লান্ত সময় কী করতে হয় সে নিজেই জানে না। বড্ড বিরক্ত, সবকিছুতেই খারাপ লাগা খোঁজার অভ্যাস। শান্তি দেয় পুরনো অ্যালবাম। ডিজিটাল মেমোরি নয়, পুরনো ছবির হার্ড কপি। গুটি কয়েক রয়েছে। সেইসবই যত্নে রাখা। চোখ যায় ছাদের ঘরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই দস্যি ছেলেবেলার দিকে। একপাশে লালপাড় সাদা শাড়িতে ঠাকুরমা। চারিদিকে দামাল রোদ। লাজুক আচার লজ্জা ভুলে এলোগায়ে শুয়ে আছে। একহাতে একটা আমের চোকলা নিয়ে দৌড়ছে ছেলেবেলা। মনে পড়ে রোদ আর আচারের সেই মাখোমাখো প্রেমের গল্প, মা-ঠাকুরমার আশকারা। ইনস্ট্যান্টের স্টান্টবাজির প্রতিরোধে বাঙালির ঘরোয়া টোটকা।
সময় যতই স্মার্ট হোক, অনুভূতি বদলায় না। ঠিক যেমন প্রেমকে ফেসবুক পোস্ট বলা যায় না। যেখানে ইচ্ছা, যখন ইচ্ছা পাবলিশ, টপাটপ লাভ, কমেন্টে চুমু, চোখের পলকে ভাইরাল, সব হতে পারে। তবে সেটা প্রেম না। আচারও তাই। ভাইরাল হওয়ার ধার ধারে না এক্কেবারে। ডাউনলোড করলে সে আসে না। ইন্টারনেট স্পিডও ম্যাটার করে না। ধারাবাহিক উপন্যাসের মতো সময় নিয়ে নিজেকে মেলে ধরে। প্রথমেই সব মিলবে না। সময় লাগবে, ধৈর্য ধরতে হবে, অপেক্ষায় আনন্দ খুঁজে পেতে হবে। চটপটে আনন্দ মিলবে নিশ্চিত, তবে সইতে হবে, রয়ে সয়ে তাকে পেতে হবে। অনলাইনে যতই যাই মিলুক তাতে স্বাদ আছে আদর নেই। খানিকক্ষণ মুখের ভিতর পুরে রেখে তারিয়ে তারিয়ে আমেজ না নিলে আচারের মজা কোথায়!
এসব দেখেশুনে বোঝা যায় মা-ঠাকুরমার আশকারা দেওয়ার কারণ। আসলে আচার মানে বিচার। একটু দীর্ঘমেয়াদি। তবু ধৈর্য ধরলে মিলবেই। হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। সেই ভরসাতে ছাদের রোদ এখনও অপেক্ষা করে। জিপিএস তার হদিশ জানে না বলে কি তার অস্তিত্ব ফুরিয়েছে! কভি নেহি! বহাল তবিয়তে না হলেও, রোদ আছে। আচারের জন্যই আছে।