উপ্রেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। বহুমুখী প্রতিভা। তাঁর কাছে বাঙালির ঋণ বহু ক্ষেত্রেই। পরাধীন দেশে ভারতবর্ষের আত্মার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই ছোটদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন মহাকাব্য। ধর্মের রিলিজিয়ন অর্থ পেরিয়ে তা ছিল দেশ চেনার অন্যতম পথ। আজ যখন ইতিহাস আর মহাকাব্যকে গোলেমালে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা, আর সেই সূত্রে হাজারও বিকৃতির ছড়াছড়ি, তখন অন্য মাত্রা নিয়েই ধরা দেয় তাঁর প্রয়াস।
লিখলেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
মর্যাদাপুরুষোত্তম রামচন্দ্র। নরচন্দ্রমা তিনি। মহাকাব্যের কবি তাঁকে আদর্শের যে চূড়ান্ত রূপ হয় এবং হতে পারে, তার কাছাকাছিই পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। আর সেই রামকেই নানাভাবে নিজের ঘরের মানুষ করে তুলেছেন আমাদের বাংলার কবি-লেখকেরা। কেবল প্রবল প্রতাপান্বিত রাজা, বীর যোদ্ধা নন, বাঙালি সেই রামকেও চিনেছিল, যিনি নিজে কাঁদেন, কাঁদানও। স্ত্রীকে হারিয়ে বিলাপ করতে যাঁর বাধে না। যিনি ভাইকে আগলে রাখেন নিজের সবটুকু দিয়ে। ব্রাহ্ম পরিবারে বেড়ে ওঠা রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা পর্যন্ত চেনে বাড়ির মহিলামহল থেকে চাকরদের আসরে অবাধ আনাগোনা করে চলা রামকে। বোঝাই যায়, এই রাম যতখানি ধর্মের, তার চেয়ে অনেক বেশি সংস্কৃতির। আর বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে জুড়ে থাকা, বাঙালির মনোভূমির বাসিন্দা সেই রামচন্দ্রকেই বাঙালির শিশুকালের সামনে উপস্থাপিত করতে চেয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী।
উপেন্দ্রকিশোর নিজেও ধর্মে ব্রাহ্ম। পৌত্তলিকতা ছেড়ে একমেবাদ্বিতীয়ম ব্রহ্মের প্রতি অনুরাগের পথ বেছে নেওয়া তাঁর স্বনির্বাচন। তবুও, রামচন্দ্রের কথা নিজের মতো করে বলতে তাঁর দ্বিধা ছিল না। কেন-না দেশের ওই সংস্কৃতিটিকেই যে চিনেছিলেন তিনি, আদর্শের প্রতিনিধি হিসেবেই রাম যার শরিক। উপেন্দ্রকিশোর মনে করতেন, রামায়ণ ও মহাভারত, এই দুই মহাকাব্যে আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ চিন্তাধারাগুলো মিশে আছে। আর সেই চিন্তাধারাকে শৈশব থেকেই সহজে বইয়ে দেওয়া ভালো, মনে হয়েছিল তাঁর। যিনি পরবর্তী কালে শিশুদের জন্য আলাদা লেখালিখির প্রয়োজন বোধ করবেন, একান্ত তাদের উপযোগী করে পত্রিকা প্রকাশ করবেন, তিনি আসলে শিশুমনকে কীভাবে সহজসুন্দর ভাবে গড়ে তোলা যায় তা নিয়েই চিন্তাভাবনা করছিলেন।
আর সেই নির্মাণের পথেই তাঁর অন্যতম সহায়ক হয়ে উঠেছিল ভারতবর্ষের দুই মহাকাব্য। না, শিশুদের ধর্মশিক্ষা দিতে হবে, এমন কোনও ধারণা তাঁর আদৌ ছিল না। তাই রাম কিংবা কৃষ্ণের ভগবৎ রূপের কথায় তিনি জোরই দেননি তাঁর অনুবাদে। কৃষ্ণের ক্ষেত্রে তাও যা বলেছেন, রামের ক্ষেত্রে তিনি প্রায় সম্পূর্ণ নীরব। ‘ছেলেদের রামায়ণ’ বইয়ের রাম নরচন্দ্রমা, শ্রেষ্ঠ মানব; কিন্তু তিনি যে বিষ্ণুর অবতার কিংবা পরমেশ্বর ভগবান— এমন কোনো বক্তব্য উপেন্দ্রকিশোর অনুবাদে স্থান দেননি। ঠিক যে ভাবনা নিয়ে তিনি সয়াজিরাও-এর কথা লেখেন, তেমনই আদর্শের রূপ হিসেবে উপেন্দ্রকিশোর আসলে রামকে শিশুদের সামনে দাঁড় করান। আর তার মধ্যে দিয়েই তাদের পরিচয় করিয়ে দিতে চান দেশের নিজস্ব কাব্য-পুরাণ-সংস্কৃতিতে লেগে থাকা জল-মাটি-হাওয়ার সঙ্গে।
শিশুরা পড়বে এবং আনন্দ করে শিখবে, শিশুসাহিত্যের কোথাও মাস্টারমশাইগিরি থাকবে না, এই ছিল উপেন্দ্রকিশোরের নীতি। তিনি যখন ‘ছেলেদের রামায়ণ’ শব্দবন্ধ প্রয়োগ করছেন, তা করছেন ছেলেমানুষ অর্থাৎ ছোটদের বোঝাতেই। ব্রাহ্মসমাজে ছেলেমেয়ে উভয়েরই শিক্ষার গুরুত্ব ছিল, আর রায় পরিবারে তো ছিলই। ফলে এর মধ্যে ছেলে-মেয়ের বিভেদ আদৌ নেই। উপেন্দ্রকিশোর ছোট ছেলেমেয়েদের রসগ্রহণের দিকটিকেই একমাত্র গুরুত্ব দিয়ে নতুন করে যে মহাকাব্য লিখলেন, তাতে আসল কাহিনি একই রইল, কিন্তু গল্প বলার সৌন্দর্যে চরিত্ররা জীবন্ত হয়ে উঠল। রামায়ণের ক্ষেত্রে তাঁর পক্ষপাত বোধহয় আরেকটু বেশি, একবার গদ্যে অনুবাদ করেই মন ভরল না, ফের পদ্যে লিখলেন রামায়ণ কাব্য। মনে রাখতে হবে, কৃত্তিবাসী রামায়ণ গান, দাশু রায়ের অনুপ্রাস-অলঙ্কারে ভরা রামের পাঁচালি বাংলার মুখে মুখে ফিরত সেকালে। ছন্দ-সুর আসলে বোঝার চেয়েও আগে বাজে। সেই মনে মনে বেজে চলাটুকুর স্বাদই হয়তো শিশুদের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। যা চলে আসছে তা যে নতুন যুগের কাছে পুরোনো হয়ে যায় সে কথা তাঁর জানা ছিল। তাই নতুন করে লেখার প্রয়োজন ছিল বইকি। আদিপর্বে তাড়কা রাক্ষসীর আক্রমণের বিবরণ দিচ্ছেন তিনি—
‘হাঁই-মাঁই-কাঁই করি ধাঁই-ধাঁই ধায়,
হুড়মুড়ি ঝোপঝাড় চুরমারি পায়।
গরজি-গরজি বুড়ি ছোটে, যেন ঝড়,
শ্বাস বয় ঘোরতর ঘড়র-ঘড়র।
কান যেন কুলো তার, দাঁত যেন মুলো।
জ্বল-জ্বল দুই চোখ জ্বলে যেন চুলো।
হাঁ করেছে দশ গজ, তাহে জিভ খান
লকলকে চকচকে, দেখে ওড়ে প্রাণ।’
এখানে আর মহাকাব্যিক বীভৎসতা নেই, এ যেন শিশুদের চেনা বাংলার সেই রূপকথার রাক্ষসী। আবার অযোধ্যাকাণ্ডে ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে ভরতের সেনাবাহিনী কী খাচ্ছে? না—
‘ঘোল, চিনি, ক্ষীর, সর, দধি, মালপুয়া,
রাবড়ি, পায়স, পিঠা, পুরী, পানতুয়া।’
একান্তই বাঙালির মিষ্টি, বাংলার খাবার। মহাকাব্যের দূরত্বকে সরিয়ে চেনাপরিচয়ের রসে জারিয়ে দেওয়া। যাতে শিশুদের মনে বসত পাতে মহাকাব্যের কাহিনি। যে কাহিনিতে দেশেরও বসত।
আসলে, উপেন্দ্রকিশোর যখন রামায়ণ অনুবাদ করছেন, দেশ তখনও পরাধীন। সে দেশের নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলার দায় অনুভব করেছিলেন তিনি। তাই রামের আদর্শকে সামনে তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু সে আদর্শের মধ্যে না ধর্ম আঁচড় কেটেছে, না নীতিবাগীশতা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধতে পেরেছে। আজকের দেশ যে একমাত্রিক রামচন্দ্রকেই সত্যি বলে জানছে, তার পালটা এক বয়ান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে উপেন্দ্রকিশোরের ‘ছেলেদের রামায়ণ’ আর ‘ছোট্ট রামায়ণ’, যা সহজ বিচিত্র আর আন্তরিক— ঠিক সেকালের ভারতবর্ষেরই মতো।