নলেন নলেন করে মায়, নলেন আসলে কে খায়! বঙ্গের বিভূষণ তো আজকাল ফরেন ট্যুরেই ব্যস্ত। বাঙালির কপালে তাহলে কি চিনি-পোড়াই সার! সকলই অরগ্যানিক, সকলই গিমিক। তা গাছেদের তো আর লেবার ইউনিয়ন নেই। অতএব দিব্যি রসেবশে আসলে-নকলে আছে নলেনের সংসার। এই শীতবেলায় নলেন্দ্র আমোদী বাঙালির হুজুগে কান পাতলেন সুপ্রিয় মিত্র।
অলংকরণ: দীপঙ্কর ভৌমিক।
কলসিতে নুড়ি ফেলে ফেলে, তলানির জল সতত অন দ্য রক্স চঞ্চুস্থ করে শ্রীমান কাক বহুদিনই পাখিদের আকাশে বাতাস কাটছেন একডানায়, ফুল সোয়্যাগে। টোটাল ক্রোকিল। গ্রীষ্মের দাবদাহময়, খাঁ খাঁ শুখা অগ্নিবাণে বাকি পাখিকুল যখন তেষ্টায় একচ্ছত্র হাঁড়িচাঁচা, কাক তখন নির্জন পাঁচ দুপুরকে ঢিল মেরে চিল করছেন। প্রয়োজন উদ্ভাবনের জনক না জননী, কী আসে যায় ঈশপ ঠাকুর? তা, জলের আকাল, সে তো কেবল নিদাঘ-সংবাদ নয়, এ ব্যাপারে ঘুরিয়ে নাক দেখাতে শীতও কম যায় না। এহেন রুক্ষ দিনে যখন সব খটখটে শুষ্ক, মানুষও কম গেল না, পাল্লা দিয়ে কাঁটামার্কা কাণ্ড চিরে নল ঢুকিয়ে, হাঁড়ি বেঁধে, বের করে আনল গাছের রক্ত! ওরে ক্কা কা, সেই মিষ্টি, উপরি হালকা বেলা পড়লে দু’চঞ্চু তোলা মাত্র মাথা কেমন ঝিমঝিম করে, কোনও এক বোধ কাজ করে, মন চনমন করে। একবার সাইডে রাখা একখান হাঁড়ির শেষ পেগে নুড়ি ফেলে, পাওয়া গেছল বটে সেই স্বাদ। লোকে মাটিতে বসে ‘কাউয়া উড়, গাইয়া উড়’ করে, আর শ্রীমান কাক ডালে বসে ঘোরাক্রান্ত দেখতে পান, গাছ কাঁদে, আকাশ পোড়ে। আর দেখেন, ব্যাটা মানুষ গাছের কাঁচা রক্ত খেয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না। তাকে আবার ফুটিয়ে রক্তমাফিক বাদামি রংও দিচ্ছে, আর গন্ধের সে কী মৌতাত! কলসিতে আবার জমিয়ে জমিয়ে রাখছে। নুড়ি ফেলে দেখতে হচ্ছে তো! যেমনি ভাবা ওমনি কাজ। যাই পাথর কুড়োই, লোকে পাহাড় রটাক।
কিন্তু হায় ক্রোকিল, পাটালি ডানার ক্রোকিল। নুড়িতে যে সে চিটকেচুপকে একসা। কী উপায় তবে? হেরে যাব? শ্রীমান বালিভুক দেখলেন, এই সান্দ্র সোনালি তরলে নুড়ির চেয়েও ক্ষুদ্র নুড়ি ভার্সন যদি ফেলা যায়, তবে সে থিতিয়ে গিয়ে খনি থেকে এনে দিতে পারে আখর কাঙ্ক্ষিত। আরেক বড় উদ্ভাবনের দিকে এগোতেই যাচ্ছিলেন শ্রীমান, ঝুরো ঝুরো তুলছিলেন ঠোঁটে করে ক্ষুদ্রতর নুড়ির সমাহার, তথা বালি। তালি বাজতে শুরু করল আশপাশ থেকে, বৃহৎ কোনও কর্মকাণ্ডের সময় মানুষ এরকম করে থাকে প্রশংসাসূচক, বায়স ভাবলেন এও বুঝি তাঁকেই লক্ষ্য করে। কিন্তু ভুল ভাঙল তালির সঙ্গে ধেয়ে আসা হ্যাট হ্যাট হুরর জগঝম্পে।
পৃথিবীতে সেই প্রথম গুড়ে পড়ল বালি। আর মানুষ শিখল চতুরামি। ঈশপ এতদূর দেখেননি। নয়তো নীতিবাক্য পালটে দিতেন— উদ্ভাবন চালাকির ব্রেনচাইল্ড। আপনি হয়তো ভাবছেন, আষাঢ়ে দেওয়ার একটা লিমিট থাকা উচিত। কিন্তু মশাই, শীতের ভোরে খেজুর গাছে বাঙালি যে শিউলি ফোটাচ্ছে, তার বেলা? শরতের শিউলিতে হচ্ছে না, পিঠেপুলিতেও চাই পুজোর আমেজ, এরকম হাড়বজ্জাত নস্টালজিক দ্বিতীয় কি আছে? এমনিতেই মানুষের মতো নৈতিক দোআঁশলা দ্বিতীয়টি নেই— প্রজাপতি হাতের মুঠোয় পিষে গেলে তা পাপ, কিন্তু মৌমাছি ঘরের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে হয়তো ভুলবশত, ওমনি মার মার মার, নয়তো হুল ফুটিয়ে দেবে কেন্দে মরে যাবি। তেমনই বৃক্ষর বেলাতেও।
শীতের শুখা দিনে খেজুর তো শুকনো পাতার নুপূর বাজিয়ে নিজের সঙ্গে ডেটিং করে দিব্য ছিল একান্তে, কারও সঙ্গে খেজুর করেনি, কাঁটাও ফোটায়নি, নিজেকে বাঁচাতে, ফল ফোটাতে, নিজের জন্য খাদ্য জমা করতে শিকড় থেকে কাণ্ডে চারিয়ে নিচ্ছিল শর্করা তরল। কাঠিটা মানুষই কিন্তু করল। অভিজ্ঞ শিউলি বা গাছিয়া তবু কতটা ছুলব, কতটা খোঁচাব, গাছও পেল, আমিও খেলাম— এসব বুঝত, কিন্তু মাত্র ক’দিনের শিনশিনে উত্তরে হাওয়া পেতে না পেতে বাঙালি যেভাবে নলেন নলেন শীৎকার তোলে, গুড়ের ভালো-মন্দ, চিনি মেশানো কি না, ভালোমতো জ্বাল দেওয়া কি না, ভোরবেলার রস নামিয়ে করা নলেন না কি বিকেলের, জিরান কাট না কি দোকাট, নোনা না কি ঝুরা, আঙুলে দিয়ে চ্যাটচ্যাট করে না কি লোতলোত— এই যাবতীয় হুজ্জতে সে খেয়াল রাখতে ভুলে গেছে, যত বিখ্যাত এই গুড় নিয়ে টানাটানি, তত বিস্তৃত নয় রে হৃদয় গৌড়! ওসব হবেখন, শিউলির অভিজ্ঞতা বাঙালির কাঠি করায় কাজে লাগুক, আমার গুড় চাই, মার খোঁচা খেজুর গাছে।
শীত পেরিয়ে গেলে বাকি বছরটা শিউলিদের কী হবে, কী খাবে, পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে সে তার হাত বালি-সিমেন্ট মাখানোর কাজে খুইয়ে ফেলে না যেন— এসব তো সে ভাবেনি, সে কেবল চেয়েছে, নলেন পরিচয়তে। ওরে ভাই, খেজুর গাছ তুমি চাঁছবে, ছুলবে, একচ্ছত্র শাইলক সাজবে, গাছের মাংস কেটে রক্ত ঝরাবে, তাতে চলবে কদ্দিন? খেজুর গাছের পরিচর্যা বিষয়ে কোনও মাথাব্যথা, তার বংশবিস্তার, চাষবাস, সংরক্ষণ বা শিউলি প্রশিক্ষণ নিয়ে কোনও গবেষণা আছে বলে খোঁজ নেই। এত গাছও নেই। অথচ, এন্তার বিকোচ্ছে গালভরা অরগ্যানিক নলেন গুড়। কলস-টলস অতীত, নলেন এখন টিউবেও মলমমাফিক হাজির! টিপলেই সোনালি-বাদামি ক্বাথ, ভাল বাংলায় ‘স্প্রেড’— পায়েস, সন্দেশ, আইসক্রিম এসব তো ছিলই; হালে পপকর্ন থেকে লাতে, ব্রাউনি থেকে চিজকেক— শীতের বাজারে নলেন এখন ফলেন এঞ্জেল। এই ছিল তবে বঙ্গমানসে ‘নব বার্তা’ রূপে বিদিত রসের নিয়তি? সে নাকি নবজীবনের বার্তা এনে দিত? পোড়া গলা চিনি ছলে-বলে-কৌশলে এভাবে মাথা মুড়োল নলেনের? হাই ডিমান্ডের ফাটকাবাজিতে, হুজুগের আদেখলেপনায় বাংলার খাস নলেন গুড়ে— চিনি কেন, পারলে কাশির সিরাপের গাবজ্বাল দিয়েও গুণাগুণের ফোয়ারা ছোটাতে উদ্যত হালের নলেন্দ্র-আমোদী বাঙালি। ইউটিউব, ফেসবুক জুড়ে ইনফ্লুয়েন্সাররা এমনিতেই খেজুরে-ওস্তাদ। তায় এখন সিজনাল গুড়-বিশেষজ্ঞ। এই হাটে গুড় ভালো, ওই বাজারে ছাঁট। যেন বাজারেই গাছ ফলে, শিউলিরও বাজারসর্বস্বতা ছাড়া কিছু নেই। দোকানি থেকে ইউটিউবার এমনভাবে ঘ্যাসঘ্যাসে গলায় আঙুল চুবিয়ে নলেনের ঘনত্ব বোঝাচ্ছেন, ‘পুরো খাঁটি নলেন, ক্কোনও কতা হবে না’, যেন মাদকের ডিলিং চলছে। এই নিশ্চয়তার ভড়ং ভোটের আগে নেতামন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিকেও হার মানায়। এভাবেই চলছে গুড় ঘিরে ঢাকঢাক গুড়গুড়। অলরাইট, ভেলিগুড়। কিন্তু, চুপিসারে যে খেজুর গাছ কাঁটাঝোপের অ্যাবিস বিশ্বে অন্তর্হিত হয়ে যাচ্ছে, তা থেকে যাবে অজানা।
আদপে, মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস আর খেজুর সরস, দুই-ই উড়ে যায়। উবে যায়। বাঙালি জানেই না, তার একান্ত গৌড়শ্লাঘা বাংলার হাতেগোনা কয়েকটা গ্রাম ব্যতীত প্রায় রাজ্যত্যাগী। বিহার-উত্তরপ্রদেশ, এমনকি ভিনদেশও ব্রতী এই সোনালি তরলের সাধনায়, বাঙালির হাই ডিমান্ডে এখন তারাই দিচ্ছে সাপ্লাই। বঙ্গে কেবল জিরান নেবে ঘাপলা। নলেন তাই ওয়াকআউট দিয়েছে অনেক দিনই। আলোকবর্ষ দূরে তারা-নক্ষত্রর মৃত্যুসংবাদ যেমন সঙ্গে সঙ্গে পৌঁছয় না, গৌড়বঙ্গর তামাম ঐতিহ্যর ক্ষেত্রেও তাই। আজ নলেন বেঙ্গল প্রোডাক্ট হিসেবে ফরেন টুর করছে, অনতিকালেই সে ফরেন এক্সক্লুসিভ আরও বাহারি কোনও নামে ফিরে আসবে। ‘নল’-‘নরকু’ থেকে ‘নলেন’ ব্যুৎপত্তির আখ্যান রাতারাতি ফেলনা হয়ে যাবে কলোনিয়াল হ্যাংয়ে, জানা যাবে হয়তো বা নলেন আদপে পদবি। ভাল নাম ক্রিস্টোফার। ভারী ইনসেপশন! আর বাঙালি লিবারাল ডাইভ মেরে আত্মপরিচয় খুইয়ে ঝাঁপ দেবে বিশ্বজনীন বার্তায়, যেভাবে পিঠে ফেলে সে কেকের আনুগত্য গ্রহণ করেছে, যেভাবে পায়েস ছেড়ে সে ডুব দিয়েছে ডেসার্টে।
অপিচ, গাছেদের তো আর লেবার ইউনিয়ন নেই। তারা কেবল অস্ফুট সরে যেতে জানে। কিন্তু, কার তাতে কী! আমরা খাব এই আকালেও নলেন চিকি। খেজুর পাতার শিরশিরানি কোন সংগ্রামের আয়োজন করছে, কী হবে ভেবে, তার চেয়ে পার্টি হোক, পাটিসাপ্টা। অপরাধবোধ তাড়াতাড়ি গিলে নিই চলুন এই বেলা। নয়তো তাড়ি হয়ে যাবে।