অন্তর্বাস একই সঙ্গে জরুরি এবং বিলাস সামগ্রীর রূপ পেয়েছে। তার দীর্ঘ ইতিহাসও আছে। ছাপোষা এই পোশাক। তবে তার গুরুত্ব কিন্তু কম নয়। অর্থনীতির ওঠাপড়া থেকে প্রতিবাদের ভাষা- অন্তর্বাসের ভিতর বাস করে অনেককিছুই।
পোশাকি ভাষায় অন্তর্বাস। তবে কেউ বলনে চাড্ডি, কেউ জাঙ্গিয়া, কাচ্চা, আন্ডারপ্যান্ট ইত্যাদি। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, পোশাক যে একটাই তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাহলে এত নামে কেন তার পরিচয়? তবে কি এই ছাপোষা অন্তর্বাসের ভিতর সমাজের নানা শ্রেণি, নানা বর্গ, নানা অর্থনৈতিক অবস্থানের মানুষের পরিচয়ও লুকিয়ে আছে? সমাজতত্ত্ববিদরা বলছেন, তা তো বটেই, এমনকী অর্থনীতির ওঠাপড়াও মেপে দিতে পারে অন্তর্বাস। হয়ে উঠতে পারে প্রতিবাদের ভাষা। কখনও আবার অন্তর্বাসের প্রকাশকই সমাজের এক ধরনের প্রগতিশীলতার চিহ্ন। অর্থাৎ যে পোশাকের স্থান সাধারণ পোশাকের আড়ালে, তাই-ই কিনা চিনিয়ে দিতে পারে সমাজের বিভিন্ন অবস্থা।
অন্তর্বাস কি জরুরি নাকি বিলাসদ্রব্য? এ প্রশ্নও কিন্তু উঠেছে বিভিন্ন সময়। বর্তমান সময়ে অন্তর্বাসের যেরকম বিজ্ঞাপন দেখতে আমরা অভ্যস্ত, তাতে মনে হয় এ যেন বিলাসেরই সামগ্রী। তবে বাস্তবিক, পোশাকের নিরিখে তা জরুরি একটি জিনিস। অন্তর্বাসের ভিতর এই দুই চরিত্রই আছে। তবে, একেবারে যে এই গুণ অন্তর্বাসের সঙ্গে জড়িয়েছে তা কিন্তু নয়। কাল কালেই এই বিবর্তন। দেখা যাচ্ছে, আজ থেকে প্রায় হাজার সাতেক বছর আগে যৌনাঙ্গ ঢাকার প্রয়োজন থেকেই অন্তর্বাসের আবির্ভাব। ফলত পোশাকটির প্রতি মানুষটির দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, ঠিক যেমনটি এসেনশিয়াল বা জরুরি দ্রব্যের প্রতি থাকে। দিন যত গড়িয়েছে, মানুষ যত সভ্যতার দিকে এগিয়েছে, তত এসেছে এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বদল। সমাজতত্ত্ববিদরা এই মনোভাব পরিবর্তনকে একটি তত্ত্বে বেঁধে ফেলেন। সেটি হল ‘থিয়োরি অগ কনফর্মিটি অ্যান্ড ডেভিয়েন্স’। এই তত্ত্ব বলে, যখন একটি জিনিস সহজলভ্য, তার গুরুত্ব খানিক পড়ে যায়। জিনিসটির আসল মূল্য বোঝা যায়, যখন তা অপ্রতুল হয়ে ওঠে। এই পথে হেঁটেই অন্তর্বাস একই সঙ্গে জরুরি এবং বিলাস সামগ্রীর রূপ পেয়েছে। তার দীর্ঘ ইতিহাসও আছে। ক্রমে ক্রমে অন্তর্বাস শুধুমাত্র প্রয়োজনের জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে পছন্দের জিনিস হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন সংস্থা অন্তর্বাস তৈরি করা শুরু করলে, পুরো পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে ওঠে। দামের হেরফের হতে থাকে। এবং কে কোন ধরনের, কোন দামের অন্তর্বাস পরবেন, তা অর্থনৈতিক অবস্থানের উপর নির্ভর করতে শুরু করে। অর্থাৎ খানিকটা বিলাসের ছোঁয়া এসে লাগে অন্তর্বাসে। তবে, তা সত্ত্বেও শেষমেশ জরুরি সামগ্রী হিসাবেই থেকে যায় অন্তর্বাস।
তবে, সবথেকে আশ্চর্য হতে হয়, যখন দেখা যায় একটি অঞ্চলের অর্থনীতির ওঠাপড়াও অন্তর্বাসের নিরিখে বুঝে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে। অর্থনীতির পরিসরে ‘মেন আন্ডারওয়ার ইনডেক্স’ নামে একটি ধারণা প্রচলিত আছে। পুরুষের অন্তর্বাসকে জরুরী সামগ্রী হিসাবে ধরে নিয়েই এই ধারণার অবতারণা। হিসাব মতো, তাহলে অন্তর্বাসের চাহিদা কমা বা বাড়ার কথা নয়, কারণ তা একান্ত দরকারি। অথচ মাঝেমধ্যে তা হয়ে থাকে। একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালে আমেরিকায় পুরুষের অন্তর্বাসের দাম কমতে থাকে। দেখা যায়, একই সময় কোভিডের কারণে আমেরিকার অর্থনীতির গ্রাফও তখন অনেকটা নেমে গিয়েছিল। ভারতের মতো দেশের ক্ষেত্রে ছেঁড়া অন্তর্বাসও অনেক সময় অর্থনীতির ইঙ্গিত দেয়। সচ্ছলতা আর দারিদ্রের পরিমাপক হয়ে উঠতে পারে এই পোশাক। এইটিই যে একমাত্র পোক্ত ধারণা তা বলা যায় না। তবে, মোটের উপর অন্তর্বাসের ব্যবহার, ব্র্যান্ডের বেছে নেওয়া একটি অঞ্চলের মানুষের অর্থনীতি সম্পর্কে ধারণা খানিকটা দিতে পারে বইকি। এই যে অর্থনৈতিক অবস্থানের বৈচিত্র, সে ইঙ্গিত রাখা আছে অন্তর্বাসের বিভিন্ন নাম ব্যবহারেও।
আবার এই অন্তর্বাস প্রতিবাদের ভাষাও হয়ে উঠেছে। নীতিপুলিশির বিরুদ্ধে যেমন চালু হয়েছিল পিঙ্ক চাড্ডি ক্যাম্পেন। পুরুষের অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ের ক্ষেত্রেও অন্তর্বাস হাতিয়ার হয়ে উঠেছে, যখন অন্তর্বাস পোড়ানোই ছিল প্রতিবাদ। আবার অন্তর্বাস প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলি উইমেন এমপাওয়ারমেন্টের প্রতীক হিসাবে কখনও ব্যবহার করেছে অন্তর্বাসকে।
অতএব ছাপোষা এই পোশাক। তবে তার গুরুত্ব কিন্তু কম নয়। অর্থনীতির ওঠাপড়া থেকে প্রতিবাদের ভাষা- অন্তর্বাসের ভিতর বাস করে অনেককিছুই। প্রয়োজন-বিলাসের এই মিলিত চরিত্র নিয়েই আমাদের অঙ্গে আর সঙ্গে থেকে যায় অন্তর্বাস।