ভোটবাজারে যেমন জোটসঙ্গীর রমরমা, শীতবাহারে তেমনই মাফলারের কদর। এ সহাবস্থান নেহাতই ইস্যুভিত্তিক। শীত নামক ইস্যুকে সামনে রেখে যতটুকু প্রয়োজন, ঠিক ততটুকুই সম্পর্ক। মানবচরিত্র আসলে স্থিতিস্থাপক, রাজনীতিও যেমন। শীতের সেশনে সেই ক্ষণিক জোটসঙ্গের বয়ান লিখলেন অর্পণ দাস। শোনালেন শঙ্খ বিশ্বাস।
ছবি: দীপঙ্কর ভৌমিক
মেট্রোয় উঠতেই সবার আগে কোপ পড়ল মাফলারটার উপর। যাক বাবা, খানিকক্ষণের জন্য মুক্তি। জ্যাকেট বাবাজীবন বহাল তবিয়তে রইলেন। টুপিটা খুলব কি খুলব না করতেই, দুটো স্টেশন পার। না, থাক। মেট্রোর উপরতলায় হাওয়া শীতাতপের মানে বোঝে না। মেরুদেশীয় শৈত্য অভ্যর্থনায় ধরতে পারবেন না, বাইরেটা কনকনে না গনগনে! তা ছাড়া, টুপি খুললে চুলগুলো ছত্রভঙ্গ সেনার মতো চারদিকে ছড়িয়ে জানান দেবে, বয়স, পেটের সমস্যা আর টেনশনে ক্রমবর্ধমান টাককে টুপি পরানো সম্ভব হচ্ছে না।
অতএব, মাফ করুন মাফলারবাবু। আপনার অবদান আমরা মনে রাখব। আপাতত আপনি গলায় গলায় বন্ধুত্ব থেকে গলার কাঁটা হয়ে উঠছেন। এখন আসুন, পরে আবার ডাক দেব। হয়তো আধঘণ্টা পরেই। পাতালপুরী থেকে বাস্তবের মাটিতে রাখলেই টের পাওয়া যাবে হাওয়া কোন দিকে। তখন ফের আপনার শরণাপন্ন হব। বহু মতবাদের দেশে আপনাকে বাদ দেওয়ার সাহস কার?
কিন্তু খবরদার! গলায় চেপে বসবেন না। জিলিপির মতো আড়াই প্যাঁচে বেঁধে ফেলেছেন বলে ভাববেন না, চক্রব্যূহ ভেদ করতে জানি না। কৃপয়া ধ্যান দেবেন, এটা মাঙ্কি টুপির জমানা নয়। গুণবিচারের আগে দেখা হয় দর্শনীয় হচ্ছে কি না। তাতে নিজস্ব দর্শনের দফারফা হলেও কুছ পরোয়া নেই। প্রয়োজনে ঠিক এক প্যাঁচ উপরে তুলে মুখ ঢেকে নেওয়া যাবে। দেউলিয়াপনার চক্ষুলজ্জা থেকে আপতকালীন মুক্তি। থুড়ি থুড়ি, চক্ষুলজ্জা নয়, বাইরের হাড়কাঁপানো ঠান্ডা থেকে। ভোটবাজারে জোটসঙ্গী হলে এটুকু আত্মত্যাগ তো করাই যায়। না হলে সটান চালান করে দেব ব্যাগের অন্ধকারে।
আরে না, না। ভয় পাবেন না। থ্রেট কালচারে আমরা বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করি না। এ নেহাত বিধিসম্মত সতর্কীকরণ। দেবে আর দিবে, মিলাবে মিলিবে। আমি আপনাকে গলার মুক্তাহার করে সাজিয়ে রাখব। লোকে দেখে বলবে, আহা মরি মরি, চলিতে চলিতে উড়িছে জয়মালা। পরনে লাল, সবুজ, গেরুয়া, হলুদ, নীলাম্বরী। পঞ্চবার্ষিকী ভোটযুদ্ধের আগে আলমারি থেকে ডাক পড়বে। এতদিন যার সঙ্গে সযত্নে বা অযত্নে মুখ দেখাদেখি বন্ধ ছিল। কিন্তু শীতের ইস্যু এলেই সমারোহে এসো হে পরম প্রিয়। ভরা মঞ্চে আলিঙ্গনে জড়াও প্রিয়ে। জনসমক্ষে পাঠিয়ে দাও সমর্থনের উষ্ণ বার্তা। দুহাতে আপনাকে আলগোছে জড়িয়ে নিই গলায়। ভোটবাক্স একটু ঠান্ডা মেরে গেলেই জানিয়ে দেব, আপনি ছাড়া আর কে রক্ষাকর্তা আছে এ দিনদুনিয়ায়?
ঠিক যেখানে যেখানে ঘাটতি, সেগুলো দেখভালের দায়িত্ব আপনার। এই ধরা যাক, মেরুকরণের হাই রোড ধরে ফিরছি। ওখানে মাফলারবাবুকে আরও ঘনিষ্ঠ করে নেওয়া যায়। বিক্ষোভের আঁচে আমরা মিঠেকড়া রোদ পোয়াব, আর শত্তুরের মুখে পড়বে ছাই। কিংবা পাহাড়ে-জঙ্গলে বহুদিন ধরেই সহ্যশক্তি কমে আসছে। ওই অঞ্চলে গেলেই কারা যেন ঠান্ডা হাওয়ার কাঁটা ফুটিয়ে দেয়। শহুরে মাফলারে আবার সেখানে শীত মানে না। সেক্ষেত্রে লোকাল দোকান থেকে আপনাকে তুলে নিতে পারলে বিরাট সুবিধা। স্থানীয় লোক খুশি। সবাই দেখল, মাফলারবাবু আমার ঘাড়ে বসে আছেন। দবদবা আপনারই। আসলে আমিই আপনার ঘাড়ে চেপে বৈতরণি পার করে গেলাম।
বদলে কী পাবেন? আহা, অত হিসেব করতে নেই। শীতের দুটো মাস যে প্রকাশ্যে ঘুরতে পারছেন, এই তো অনেক। না হলে কে আর বলুন, বাক্স খুলে মাফলার খুঁজতে ভালোবাসে? আচ্ছা, ঠিক আছে, বাড়ি ফিরেই আর আপনাকে যেখানে সেখানে টান মেরে খুলে ফেলব না। আপনাকে যথোপযুক্ত আসন দেব। যে ফুটোফাটাগুলো আছে, সেগুলো সারানোর ব্যবস্থা করে দেব। আরে না, না। রাজনীতিবিদদের মতো ফাঁপা প্রতিশ্রতি নয়। পমিস, এবার আপনাকে মাথায় তুলে রাখব।
কিন্তু এটাও আশা করি ভুলবেন না যে, আমাদের জোট ইস্যুভিত্তিক। গ্রীষ্মপ্রধান দেশে বাকি পোশাকআশাকের সঙ্গে আপনার বিস্তর ফারাক। আমরা শুধু একত্রিত হয়েছি, শীত নামক ইস্যুকে সামনে রেখে। তাই রোঁয়া তুলে বেশি জ্ঞানবাক্য কপচালে পস্তাতেই হবে। শৈত্যপ্রবাহ একটু উনিশ-বিশ হলেই মাফলারবাবুকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। কোন জেলখানায় তখন পড়ে থাকবেন, কে বলতে পারে? তা ছাড়া এখন তো বাজারে হরেকরকম মাফলার উঠেছে। একটু দরদাম করলেই কিন্তু আপনার থেকে ভালো কাউকে পেয়ে যেতেই পারি। সেটাও মাথায় রাখবেন।
‘পরবর্তী স্টেশন অমুক’। মেট্রোর ঘোষিকা মনে করিয়ে দিলেন গন্তব্য স্টেশনে পৌঁছে গিয়েছি। সহযাত্রীদের মধ্যে অতিসাবধানী কয়েকজন মাফলারটা শক্ত করে নিলেন। বাইরের বিপদ সম্পর্কে তাঁরা বিন্দুমাত্র ঝুঁকি নিতে রাজি নন। আবার কেউ কেউ মালার মতো ঝুলিয়ে রেখেছেন মাফলারকে। প্রয়োজন পড়লে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। হুড়মুড় করে লোক নামছে স্টেশনে। মেট্রোর শূন্যস্থান ভরিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল একদল। দরজা বন্ধ হওয়ার আগে পিছনে ঘুরে দেখা গেল, নতুন যাত্রীরাও মাফলার খুলতে ব্যস্ত। মানবচরিত্র আসলে স্থিতিস্থাপক। রাজনীতিই বা আলাদা কেন হবে? যার যতটুকু প্রয়োজন, তার সঙ্গে ঠিক ততটুকুই সম্পর্ক। ইস্যুভিত্তিক।
চলমান সিঁড়ি উঠছে ব্যস্ত শহরের দিকে। প্রথমবার পাহাড় দেখার মতো দিনের আলো এগিয়ে আসছে সামনে। শীতের টুপি খুলে হাতে চলে এসেছে। আশেপাশে শোনা যাচ্ছে, জ্যাকেটের চেন খোলার হালকা শব্দ। না, বাইরে তেমন ঠান্ডা নেই। মাফলারবাবুকে অনায়াসে ব্যাগে ঠাঁই দেওয়া যায়। পরবর্তী ৮-১০ ঘণ্টা ওখানেই থাকুন। নিরাপদ আস্তানায়। বর্ষায় ছাতা হারানোর ঘটনা তো আকছার ঘটে। শীতের টুপিও অনেকে হারায় শুনেছি। কিন্তু মাফলার? নৈব নৈব চ। ইস্যুভিত্তিক হতে পারে, কিন্তু এরকম বিশ্বস্ত জোটসঙ্গীই বা আজকাল কোথায় পাওয়া যায়?