বছর ফুরোনোর আগেই চলে গেলেন উস্তাদ জাকির হুসেন। শোকস্তব্ধ গোটা বিশ্বের সঙ্গীতমহল। উস্তাদের ফেলে যাওয়া সবকিছু আগলে রাখার পণ করছেন সতীর্থরা। এই আবহে উস্তাদ জাকির হুসেনের সঙ্গে কাটানো অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন পণ্ডিত অমিত ঘোষ।
সময়টা ঠিক মনে নেই, তাও ৩০ বছর আগেকার তো বটেই! উস্তাদ জাকির হুসেনের সঙ্গে বেশ কয়েক ঘণ্টা কাটানোর সুযোগ হয়েছিল। সেবার আমার গুরুজি পণ্ডিত শ্যামল বোসের জন্মদিনের উস্তাদ জাকির হুসেনের বাজানোর কথা। কলা মন্দিরে অনুষ্ঠান। তার আগে আমার দায়িত্ব উস্তাদকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে হোটেলে পৌঁছে দেওয়ার। সেখানেই সারাদিন থাকা, সন্ধেবেলা একেবারে অনুষ্ঠান মঞ্চে পৌঁছানো। সেদিনের কথা ভাবলে এখনও শিহরিত হই। কারণটা অবশ্যই উস্তাদ জাকির হুসেন!
এত বড় একজন মানুষের সঙ্গে সময় কাটাব, এই ভাবনায় রাতের ঘুম উড়েছিল। যথারীতি সেই দিন এল, সময়মতো পৌঁছে গেলাম এয়ারপোর্টে। উস্তাদ জাকিরও এলেন ঠিক সময়েই। দুজনে মিলে গাড়ি করে হোটেলের উদ্দেশে রওনা হলাম। এত বড় একজন শিল্পী, তাঁর সঙ্গে কী কথা বলব, কীভাবে কথা বলব, এইসব ভাবনা চলছিলই। তবে উস্তাদজি নিজেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি বড় শিল্পী হলেও কত সহজ একজন মানুষ। বিভিন্ন বিষয়ে সেদিন কথা হয়েছিল। অবশ্যই বাজনা সংক্রান্ত। লক্ষ করেছিলাম কী ভীষণ বিনয়ের সঙ্গে কথা বলেন উস্তাদজি।
যে প্রসঙ্গই উঠুক না কেন, তাঁর উত্তরে সবসময় বিনয় মেশানো ছিল। এবং তা মেকি নয় এতটুকু। কথায় কথায় অন্যান্য যেসব শিল্পীর নাম উঠে আসছিল, তাঁদের প্রত্যেককে প্রণাম জানাচ্ছিলেন জাকির হুসেন। একজনও বাদ পড়েননি। এত বড় শিল্পী হয়েও কীভাবে অন্য শিল্পীদের সম্মান জানাতে হয়, তা ভালোমতো জানতেন জাকিরজি। সেদিন তাঁর কাছ থেকে বিনয়ের পাঠ শিখেছিলাম। বুঝেছিলাম স্রেফ বড় শিল্পী হলেও চলবে না, বড় মানুষ হওয়াটাও জরুরি।
শুধু ওই একবার নয়, উস্তাদের এই বিনয়ী স্বভাবের পরিচয় আগেও পেয়েছি। তার আগে জাকিরজির কিছু অনন্য গুণের কথা না বললেই নয়। মার্গ সঙ্গীতে তাঁর পাণ্ডিত্য নিয়ে কিছু বলা ধৃষ্টতা। প্রকৃত অর্থে তবলায় কথা বলা কাকে বলে, তা বুঝিয়েছিলেন উস্তাদ জাকির হুসেন। তবলায় নানারকম শব্দ করতে পারতেন তিনি! ট্রেন থেকে শুরু করে ঝরনা, তাঁর হাতের নির্দেশে অবিকল নকল করতে পারত তাঁর তবলা। এমনই এক সঙ্গীত সম্মেলনে আমার গুরু পণ্ডিত শ্যামল বোসের সঙ্গে উস্তাদ জাকির হুসেনের বাজনা শুনতে গিয়েছি। একের পর এক অন্যন্য কায়দা বাজাচ্ছেন জাকিরজি। হাততালিতে ফেটে পড়ছে প্রেক্ষাগৃহ। রাগসঙ্গীতের পাশাপাশি উস্তাদ শোনালেন তাঁর নিজস্ব কিছু বাজনা। সেখানে ট্রেনের আওয়াজ, বাঘের গর্জন, ঝরনার শব্দ ইত্যাদি অনেক কিছুই ছিল।
সবার কাছে সেই বাজনা অভাবনীয় মনে হলেও, গুরুজির তেমন মনোগ্রাহী হল না। নেতিবাচক কিছু না বললেও, তবলায় এই ধরনের কায়দা খুব একটা পছন্দ করেননি তিনি, সেটা বোঝাই যাচ্ছিল। যথাসময়ে অনুষ্ঠান শেষ হল। মঞ্চ থেকে নেমে এসে গুরুজিকে প্রণাম করলেন জাকির হুসেন। জানতে চাইলেন ‘বাজনা কেমন লেগেছে?’ মৃদু হেসে খানিক এড়িয়েই গেলেন গুরুজি। ছোট করে বললেন, ‘ঠিক হ্যায় বেটা।’ জাকির তখন দেশের তো বটেই, বিশ্বের দরবারেও সমাদৃত শিল্পী। কিন্তু তাঁর গুরুস্থানীয় কেউ এমন অল্প কথায় বাজনার মূল্যায়ন করায়, খানিক অবাক হলেন। বিষয়টাকে এড়িয়ে না গিয়ে, তিনি আবার জানতে চাইলেন কেমন হয়েছে বাজনা! এরপর খানিক উত্তেজিত হয়েই গুরুজি বললেন তাঁর মনের কথা। আসলে, মার্গ সঙ্গীতে এই ধরনের ঝরনার শব্দ বা ট্রেনের শব্দ করা যে সিলেবাসের বাইরে, তাই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন পণ্ডিত শ্যামল বোস। তবে তাঁর প্রতিক্রিয়া জেনে এতটুকু বিচলিত হননি জাকির। বরং বিনয়ের সুরে উত্তর দিয়েছিলেন, তাঁদের মতো অর্থাৎ গুরুজিদের মতো তবলা তাঁর হাতে আসে না! আর এইসব তাঁকে করতে হয় দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য।
এতটুকু অহমিকা নেই, এতটুকু উত্তেজনা নেই, সহজ সুন্দর ভাষায় বয়সে অভিজ্ঞতায় বড় একজন শিল্পীকে সেদিন উত্তর দিয়েছিলেন আরেক শিল্পী। অবাক হয়ে দেখেছিলাম বিনয় কাকে বলে! জাকির হুসেন সম্পর্কে এমন ঘটনা আরও শুনেছি। কখনও নিজের বাঁয়া তবলা অন্য কাউকে নিয়ে যেতে দিতেন না। নিজে হাতে নিয়ে মঞ্চে উঠতেন। এবং এই অভ্যাস বদলাননি কোনও দিন। তাঁর মুখেই শুনেছি, কোনও এক সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে নিজের জীবনের সেরা যাত্রাপথ হিসেবে ওই গ্রিনরুম থেকে মঞ্চ অবধি তবলা নিয়ে যাওয়ার কথাই বলেছিলেন জাকির হুসেন। এমন বিনয়, এমন সহজতা না থাকলে এত বড় শিল্পী হওয়া যায় না বোধহয়।
যাই হোক, অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গে ফিরি। সেদিন অনুষ্ঠান শুরুর খানিক আগেই আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম প্রেক্ষাগৃহে। গ্রিনরুমে বেশ খানিকক্ষণ রেওয়াজ করলেন জাকিরজি। হাতে একটা ভারী বালা পরে রেওয়াজ করেছিলেন, বেশ মনে আছে সেই কথা। স্বল্পাহারী ছিলেন, খাদ্যাভ্যাস দেখেও অবাক হয়েছিলাম। সারাদিন জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা ভাগ করে নিয়েছিলেন উস্তাদ। তবে কোনও ক্ষেত্রেই মনে হয়নি নিজের বড়াই করছেন। সবসময় স্মিত হাসি আর বিনয় মিশে ছিল তাঁর কথায়। ভীষণ সংযত জীবনযাপন করতেন। সেদিনের কথা ভাবলে আজও শিহরিত হই। বিশেষ করে আজ, যখন জানতে পারলাম উস্তাদজি আর আমাদের মধ্যে নেই! সঙ্গীত জগতের অপূরণীয় ক্ষতি, এ ক্ষতি কোনও দিন পূরণ হবে না বলেই মনে করি। তবে তিনি যা রেখে গেলেন তা যত্ন করে রেখে দেওয়া আমাদের কর্তব্য, যা আগামী প্রজন্মের পাথেয় হিসেবে থেকে যাবে।