যাবতীয় শৈত্যের শুশ্রূষায় গরম জলের ওম নিয়ে হাজির গিজার নামের যন্ত্র। হিমশীতল জলে সে ভরে দেয় উষ্ণতার শ্বাস। যদিও সেই দেওয়া কিংবা না-দেওয়া তার স্বেচ্ছাধীন নয়, কেন-না সুইচ আপনারই হাতে। যে কোনও সিস্টেমের মতোই। আর সিস্টেমের অধীনে থাকা চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক যেমন, গিজারকেও তেমনই কাজ করে যেতেই হয়। শীতকালীন স্নানপ্রক্রিয়া যে এমন পলিটিক্যালও হয়ে উঠেছে, তা বোঝালেন রোদ্দুর মিত্র। শোনালেন শঙ্খ বিশ্বাস।
ছবি: দীপঙ্কর ভৌমিক
অথচ ছেলেবেলায় দেখা মেলেনি। কিংবা দেখা পেলেও বিস্মরণের পথেই হেঁটেছিল সে। অগত্যা স্মৃতির কুয়ো থেকে উঠে আসতে চাইছে একটা শীতকাল। বেলা দশটার রোদে যেমন পড়ে পড়ে ল্যাদ খাচ্ছে খান পাঁচেক লেপ, তিন বয়াম চালতার আচার, তেমনই আছে দু-বালতি জল। যখন রোদে ঝিম ধরে যাবে সম্পূর্ণ, যখন কমলালেবুভাঙা আলো আর মায়ের ওমে জল উষ্ণ, স্নানের তোড়জোড় শুরু! আয়োজন ছাপোষা এবং দুর্মূল্য। যেন শীতকালীন ঘরোয়া উৎসব।
আমাদের এই উত্তর-আধুনিক সময়, সযন্ত্রে, রিপ্লেস করেছে জল গরমের টেকনিক। রিপ্লেস করেছে মা-সমেত যাবতীয় সম্পর্কের ওম। তুমি গেছ, উনুন গেছে, গিজার এসেছে। কখনও ভেবেছিলেন মশাই, স্যুইচ টিপলে জলও ফুটে উঠবে? টগবগিয়ে? একেবারে ধোঁয়া ধোঁয়া স্নানের জল, দু-মিনিটেই রেডি।
গিজার আসলে একুশ শতকের চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক। গায়ে দুটি আলো। লাল এবং সবুজ। এখানেও গেরুয়া সিনে নেই। চুক্তির ঋতু, মূলত গোটা শীতকাল! সময়সীমা? আপনি যতখানি গরম সইতে প্রস্তুত। শ্রমিকেরা যদি শীত গ্রীষ্মের তফাত বুঝতে শুরু করে, তবে বিপ্লব হয়ে যায় মশাই! রাষ্ট্র বা পুঁজি কোনও দিন তা চাইবে? কাজেই আপনার হাতে স্যুইচ। অর্থ হয়, আপনার হাতে পাওয়ার। আপনি রাষ্ট্র। যেমন খুশি, হোক সে কুৎসিত, তবু শ্রমিকের নিয়ন্ত্রণ আপনারই হাতে। কী? এইবার নিজেকে মনে হচ্ছে রাষ্ট্রনেতা? নলেন গুড় আর বোরোলীন-সর্বস্ব যে মধ্যবিত্ত মেলানকোলিক শীতকাল, তার ভেতরেই কেমন লুকিয়েছিল হেবি একটা উত্তাপের মায়াজাল। স্নানঘরেই! এ উত্তাপ কি ক্ষমতার? আপনি খেয়াল করেননি! করলেই দেখতে পাবেন ছাপ্পান্ন ইঞ্চির ইয়াব্বড়ো ছাতি। গিজার যেহেতু চুক্তিবদ্ধ সে জল গরম করেই যাবে…
র্যাপিডো। জোম্যাটো। ব্লিঙ্কইট। ইত্যাদি। ইত্যাদি। বিশ্ববাজারে চুক্তিভিত্তিক শ্রম আপাতত ট্রেন্ডিং। শ্রমিকেরা জেনেছিল, শৃঙ্খল ছাড়া তাদের হারানোর কিছু নেই। পুঁজিবাদ কিংবা রাষ্ট্র তাই গুঁড়িয়ে দিয়েছে শৃঙ্খল। স্থায়ী শ্রমের চেতনা। শ্রমিক এখন একা। অসংগঠিত। নিরাপত্তাহীন। তবু, সহজলভ্য। কেন? দাস ক্যাপিটালে কার্ল মার্ক্স লিখছেন: আধুনিক ধনতান্ত্রিক সমাজ, মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা না করে, বস্তুতে পরিণত করেছে। অতএব, রাষ্ট্রের চোখে শ্রমিকও একপ্রকার বস্তু। তাই সহজলভ্য। সে বাড়ি ফিরল, না ট্রেনে কাটা পড়ল—দায় নেওয়ার আপনি কে হে?
গিজার চালিয়েছেন কতক্ষণ হল? জল ছুঁয়ে দেখুন। স্নানের জলে যে উষ্ণতা, তা খানিক আগ্রাসী। নরম নরম ওম নেই। যেন শ্রমিকের ক্রোধ মিশে আছে খুব। চুক্তিপত্রে শ্রমের মূল্য এতই সামান্য যে পেট ভরে না! তবু সেই গিজার ফেটে পড়ছে না রাগে। ঘেঁটে দিচ্ছে না স্নানঘরের স্বস্তি। অথবা বলছে না, আজ আমাদের ছুটি। ঠান্ডা জলেই স্নান করতে হবে আপনাকে। সে ওখানেই পচছে, মরছে, হোঁচট খাচ্ছে, আর হিমশীতল জলে ভরে ভরে দিচ্ছে উষ্ণতার শ্বাস। আপনি স্নান করছেন। প্রয়োজনে মিশিয়ে নিচ্ছেন ঠান্ডা জল। পাওয়ার তো আপনার হাতে। ওহ! কী আরাম!
যদি আপনি এতক্ষণে রাষ্ট্রনেতা হওয়ার স্বপ্নে কিঞ্চিৎ বিভোর হয়ে পড়েছেন, গরম জলের ধোঁয়ার আশ্চর্য ভ্যাকুয়ামে মেলে ধরেছে দুটো হাত, তবেই কেল্লাফতে। শীতকালীন স্নানপ্রক্রিয়া কী চমৎকার পলিটিক্যাল হয়ে উঠল, বলুন! এরপরই ম্যাজিক। শুধু শীতকাল নয়, মনে হবে শ্রমিকের সঙ্গে চুক্তি সেরে ফেলি লোকসভা বিধানসভা নির্বাচনের আগে আগে। আমাদের রক্তের গভীরে যে জাতীয়তাবাদ অথবা সিমপ্যাথি— ইচ্ছে করবে উষ্ণ, আরও উষ্ণ করে তুলতে। জল গরম হচ্ছে ক্রমশ। রাষ্ট্রনেতারা কেবল স্যুইচ টিপে দিয়েছেন।
প্রতিটি নাগরিকের টাইমকলে তখন গরম জল। ধর্মের। বিদ্বেষের। হেট স্পিচের। অপতথ্যের। সে জলেই আমরা স্নান করে নিলাম অনর্গল। যেন শুদ্ধ হলাম। সনাতন কোনও আলো এসে পড়ল। মনে হল, আমাদের দেশপ্রেমের ভরা জোয়ার নির্ভর করে আছে প্রতিবেশী দেশগুলোর দুর্দশা ও দুর্নীতির ওপরে। ব্যস। অমনি আমরা চাঙ্গা। শঙ্খ ঘোষের একটি কবিতার কথা মনে পড়ছে হে পাঠক। লিখছেন: ‘‘যে-আলো তোমার গায়ে এসে পড়ে/ সে-আলোয় আমি নজর রাখছি/ এমনকী এও হতে পারে— সেই/ আলোর ভেতরে আমিই থাকছি’’…
হে গিজার, হে আমাদের চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক, তোমার অজান্তেই, তোমারই শ্রমে, কতশত ঘেন্নার দরজা খুলে গেল, খেয়াল করেছ? এ শীতকাল যে আরও ঘনিয়ে উঠছে। ঠোঁট ফেটেছে। গোড়ালি ফেটেছে। মানচিত্র ফেটেছে। তবু এমন কোনও আশ্চর্য ধোঁয়া ধোঁয়া গরমজলে স্নান করাতে পারো না পূর্ব-পশ্চিম? উত্তর-দক্ষিণ? সারিয়ে দিতে পারো না আমাদের যাবতীয় ক্ষত?