স্লোগানে প্ল্যাকার্ডে প্রতিবাদ তো থাকবেই। কিন্তু নতুন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিবাদের নতুন ভাষ্যকেও তো তৈরি হতেই হত। পুরোনো ট্রেন্ড পেরিয়ে এসে প্রতিবাদও এখন ট্রেন্ডি, অভিনব জামা-ব্যাগে বোঝালেন রাহুল-প্রিয়াঙ্কা।
স্লোগানে মিছিলে প্রতিবাদের ভাষা চেনে রাজনীতি। কিন্তু বদলে যাওয়া দিনে বদলাচ্ছে রাজনীতির সেই চেনা ভাষাও। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিবাদ তার ভাষা খুঁজে নিচ্ছে নতুন নতুন পথে। পুরনো ট্রেন্ড পেরিয়ে এসে প্রতিবাদও এখন ট্রেন্ডি। আদানি ইস্যুতে প্রতিবাদী স্টেটমেন্টের ব্যাগ হাতে সংসদে হাজির হয়ে সে কথাই যেন নতুন করে বুঝিয়ে দিলেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী।
সংসদে-বিধানসভায় শাসকের বিরুদ্ধে সুর চড়াবেন বিরোধীরা- সে তো জানা কথাই। কখনও প্ল্যাকার্ডে বিরোধিতার বার্তা লিখে জমায়েত করেন তাঁরা, কখনও দেখা যায় স্লোগানের রকমফের। সংবিধান হাতে বা শিবের ছবি তুলে ধরে চোখা বক্তব্যে মোদি শিবিরকে বিঁধেছেন বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী, তাও দেখা গিয়েছে। কিন্তু একালের প্রতিবাদ আর কেবল বক্তব্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। ভাবনার প্রকাশ এখন শুধুমাত্র কী বলছি-তে আটকে নেই, কী পরছি-তেও পড়ছে তার ছাপ। সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে সম্প্রতিই মুখোশ পরে আদানি ইস্যুতে বিরোধিতার বার্তা দিয়েছিলেন কংগ্রেস নেতারা। আদানির মাস্ক পরা মানিকম টেগোর এবং মোদির মুখোশে শিবাজিরাও অধলরাও পাটিলের নকল সাক্ষাৎকার নেন রাহুল গান্ধী। আর এবার আদানি-মোদির সম্পর্ক টেনেই অভিনব ব্যাগ নিয়ে এসে খোঁচা দিলেন প্রিয়াঙ্কা। সে ব্যাগের একদিকে মোদি ও আদানির ছবি, অন্যদিকে লেখা ‘মোদি-আদানি ভাই ভাই’। দিনকয়েক আগেই প্রিয়াঙ্কা-সহ কংগ্রেস নেতারা পরেছিলেন নয়া জ্যাকেট, যার পিঠে লেখা ‘মোদি-আদানি এক হ্যায়’। রাহুলের সিগনেচার সাদা টিশার্টের পিছনেও ছিল একই বার্তা। সম্প্রতিই তেলেঙ্গানা বিধানসভায় আবার ‘আদানি রেবন্ত ভাই ভাই’ লেখা টিশার্ট পরে কংগ্রেসকে তোপ দেগেছেন বিআরএস নেতারা।
পোশাকের মাধ্যমে প্রতিবাদের ভাষা অবশ্য রাজনীতি রপ্ত করতে শুরু করেছে আগে থেকেই। ২০১৯ সালে আর্থিক কেলেঙ্কারির দায়ে মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনার সুপ্রিমো রাজ ঠাকরেকে তলব করে ইডি। তিনি ইডি দপ্তরে হাজিরা দিতে গেলে ‘ইডিয়ট হিটলার’ লেখা টিশার্ট পরে দপ্তরের বাইরে বিক্ষোভ দেখান দলীয় কর্মীরা। বছর দুই আগে অমিত শাহর ছবি আঁকা আর ‘পাপ্পু’ লেখা টি-শার্ট পরে প্রতিবাদ করতে দেখা গিয়েছিল তৃণমূলকে। কেন্দ্রীয় সরকার পেট্রোলের লিটার পিছু ৫০ টাকা করে বেশি নিচ্ছে বলে তেলের দাম বাড়ছে, এই ছিল তাদের বক্তব্য। সেই টি-শার্ট পরেই সংসদেও যান তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ ডেরেক ও ব্রায়েন। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ইন্ডিয়া’জ বিগেস্ট পাপ্পু অমিত শাহ’ বলে কটাক্ষ করে ক্যাম্পেন শুরু করেছিলেন। সেই ক্যাম্পেনই ছড়িয়ে পড়ে টিশার্টের হাত ধরে। চলতি বছরেই মার্চ মাসে, আবগারি মামলায় কেজরিওয়ালকে ইডি গ্রেপ্তার করার পর অভিনব প্রতিবাদে শামিল হন অতীশী-সৌরভ সহ আপ নেতা-কর্মীরা। কেজরিওয়ালের মুখোশ, আর ‘ম্যায় ভি কেজরিওয়াল’ লেখা হলুদ টিশার্ট পরে বিধানসভায় হাজির হন আপ বিধায়কেরা। দেখা যাচ্ছে, প্রতিবাদের নিশান হিসেবে প্ল্যাকার্ডের পাশাপাশি মুখোশও উঠে এসেছে চর্চায়। একইসঙ্গে, প্রতিবাদের জন্য আলাদা করে কোনও প্রপস ব্যবহার না করে, নিত্য ব্যবহারের অ্যাকসেসরিজেই প্রতিবাদের ছাপ জুড়ে নিচ্ছেন অনেকে।
সত্যি বলতে, টিশার্টের গায়ে বার্তা দেওয়ার চল হয়েছিল প্রতিবাদের এই ধরন থেকেই। ১৯৮৩ সালে ব্রিটিশ ফ্যাশন ডিজাইনার ক্যাথরিন হ্যামনেট একটা দুধসাদা টিশার্টের উপরে লিখে দেন, ‘চুজ লাইফ’ অর্থাৎ ‘জীবনকে বেছে নাও।’ অনেকেই বলেন এই দুটি শব্দের মাধ্যমে যুদ্ধবিরোধী এক কড়া বার্তা দিতে চেয়েছিলেন হ্যামনেট। তার পর থেকে টিশার্ট, জ্যাকেট, নানারকম পোশাকই বেছে নেওয়া হয়েছে প্রতিবাদের বার্তা লিখতে। মনোবিদরা বলেন, আসলে মনের কথাকে এভাবে অনেকটা বড় করে দেখানো যাচ্ছে বলে মনে করেন প্রতিবাদীরা। আবার যেখানে স্পষ্ট কথায় প্রতিবাদ করলে কণ্ঠরোধের ভয়, সেখানে অমন বড় বা চিৎকৃত প্রতিবাদের বদলে বেছে নেওয়া হয়েছে অ্যাকসেসরিজ। আর এভাবেই কখনও ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার, কখনও গাজার গণহত্যা জুড়ে গিয়েছে সাজপোশাকের সঙ্গে। কানের রেড কার্পেটে যেমন প্যালেস্তাইনের প্রতীক, প্যালেস্তাইনের পাশে দাঁড়ানোর প্রতীক স্কার্ফ দিয়ে পোশাক বানিয়েছিলেন সুপারমডেল বেলা হাদিদ। লরা ব্লাজম্যান-কাদারের পোশাক জুড়ে ছিল প্যালেস্তাইনের নিহত মানুষদের ছবি। জোর গলায় প্রতিবাদ করলে তা দমন করা হচ্ছে, তাই লাল-সবুজ-কালো-সাদা চার রং থাকা তরমুজকে প্যালেস্তাইনের প্রতীক করে তুলেছেন প্রতিবাদীরা। ওয়াটারমেলন পিন বা ব্যাজ, একফালি তরমুজের মতো ব্যাগ হাতে প্রতিবাদী বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন তাঁরা।
স্লোগানে প্ল্যাকার্ডে প্রতিবাদ তো থাকবেই। কিন্তু নতুন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিবাদের নতুন ভাষ্যকেও তো তৈরি হতেই হত। কেউ বলতেই পারেন, টিশার্ট-পোশাকের প্রতিবাদ আসলে পণ্যায়নেরই রকমফের। কিন্তু পুঁজির দুনিয়ায় সবই যখন পণ্য হয়ে উঠছে, তখন প্রতিবাদের পক্ষেও কি সেই দুনিয়াকে পুরোপুরি ছাড় দেওয়া সম্ভব? বরং একইরকম সাজের যৌথতা যদি পণ্যের দুনিয়ায় প্রতিবাদের একরকম নয়া স্টেটমেন্ট তৈরি করে, মানুষকে যদি সাজের ছলেও ভাবতে শেখায়, মন্দ কী!