গোটা গ্রামে কারও কাছে নেই মোবাইল। অবশ্য থেকেও লাভ হত না। কারণ চার্জ দেওয়ার জায়গা নেই। স্বাধীনতার এত বছর পরেও, এই গ্রাম বিদ্যুৎহীন! শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি। এই দেশেই রয়েছে এমন গ্রাম। কোথায় জানেন? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
বিদ্যুৎ নেই। তাতে সমস্যাও নেই কারও। আলো-পাখা ছাড়াই দিব্য রয়েছেন গ্রামের সকলে। শুধু তাই নয়, গ্রামের কারও পকেটে নেই মোবাইল ফোন। তাতেও নিশ্চিন্তে দিন কাটান গ্রামবাসী। কী ভাবছেন, সিনেমার গল্প? মোটেও না। এ দেশেই রয়েছে এমন গ্রাম।
সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে রাতে বিছানায় যাওয়া। মাঝের সবটুকু সময়ে আমাদের সঙ্গে জুড়ে আছে কোনও না কোনও ইলেকট্রিক ডিভাইস। আলো, পাখা, জামাকাপড় কাচার যন্ত্র, এসি, আরও কত কি! তবে সবথেকে বেশি যে যন্ত্রকে ঘিরে থাকা, সেটি অবশ্যই মোবাইল ফোন। খাবার অর্ডার কিংবা অল্প সময়ের মধ্যে দরকারি জিনিস হাতে পাওয়া, মোবাইল থাকে সব সম্ভব। তবে মোবাইল তো আর এমনি এমনি চলবে না! নিয়মিত চার্জ দিতে হবে। সেই ব্যবস্থা না থাকলে লাখ টাকা দামের ফোনও অকেজো। শুনলে মনে হবে, চার্জ দেওয়া আর এমন কী ব্যাপার! প্লাগ পয়েন্টে চার্জার আটকে দিলেই ফোনের ব্যাটারি চার্জ হয়ে যাবে। কিন্তু না, এমনও এক গ্রাম রয়েছে যেখানে চার্জ দেওয়ার কোনও ব্যবস্থাই নেই। কারণ তা সম্পূর্ণ বিদ্যুৎহীন। এই গ্রামের বাসিন্দারা এখনও নিজেদের পালন করে চলেছেন সেই ফেলে আসা প্রাচীন দিনলিপিতে। প্রায় সব বাড়িই তৈরি হয়েছে মাটি দিয়ে। শুধু মাটি নয়, তাতে রয়েছে চুন এবং গোবরও। যা ব্যবহার হয় ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ করতে।
আরও শুনুন: দেড় বছর ধরে একটানা জ্বলছে সাত হাজার আলো, অদ্ভুত বিভ্রাট স্কুলে
গ্রামবাসীরা চাষবাসের ফলনের জন্য যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো করে নেয় নিজেরাই। ট্র্যাক্টর অথবা অন্যান্য কোনও আধুনিক প্রযুক্তির সুযোগ যেহেতু নেই, তাই নিজে হাতেই লেগে পড়ে চাষাবাদের কাজে। তৈরি করে জৈব সার। আর তা দিয়েই ফুলে ফলে ভরে ওঠে গ্রামের মাটি। এ যেন ঠিক সেই প্রাচীনকালের বৈদিক গ্রামের মতো। আমরা জানি সেযুগে মুনিঋষিরা তৈরি করতেন গুরুগৃহ, আর গুরুগৃহে আসা আশ্রমবালকরা গড়ে তুলত এক অদ্ভুত জীবনচর্যা, এও তেমন। যা কিছু কৃত্রিম, যা কিছু অতিরিক্ত- সবটুকু ছেঁকে বাদ দিয়েছে কুরমা গ্রামের গ্রামবাসীরা। বলা ভাল যা কিছু কৃত্রিম, যা কিছু অতিরিক্ত, তার কোনকিছু গ্রহণই করেনি তাঁরা। বরং, তাঁদের বুকের ভিতর লালন করেছে দেশের সবটুকু খাঁটি। সম্প্রতি একটি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে গ্রামের এক বাসিন্দা কৃষ্ণ চরণ দাস জানিয়েছেন, পূর্বপুরুষদের মতোই তাঁরা নাকি এখনও বাড়িতে জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করেন। আগেকার দিনে একান্নবর্তী পরিবারে এবং পরিবেশনির্ভর জীবনে এত জটিলতা ছিল না। আর সেই ধারাবাহিকতাকেই বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।
এগিয়ে থাকার লড়াইয়ে আমরা যতই প্রকৃতিকে জীবন থেকে বাদ দিয়েছি, ততই একা হয়ে পড়েছি। আর তারই প্রমাণস্বরূপ আজকের যাবতীয় প্রাকৃতিক সমস্যা। তবে সমস্যা কি শুধু বাইরে? মনের ভিতরেও যে জমেছে গভীর অন্ধকার, তা খুব স্পষ্ট। আর সেই প্রশ্নে এই গ্রামের নজির যে আরও একটি দ্বন্দ্ব এনেছে তা বলা বাহুল্য। অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীকাকুলাম শহর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই কুরমা গ্রাম। প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনসাসনেস ওরফে ইসকনে দ্বারা। আর সেই তপোবনের দীক্ষা তাঁরা এখনও এগিয়ে নিয়ে চলেছে তাঁদের জীবনচর্যায়। কুরমা গ্রাম বিশ্বায়নের প্রতিযোগিতায় কতটা এগিয়ে থাকবে তা জানা নেই। তবে এমন অতুলনীয় জীবনচর্যার কারণে ইতিহাসের পাতায় যে তাদের নাম রয়ে যেতে পারে,তা বললে ভুল হয় না।