এতদিন মুখবন্ধ খামের নাম ছিল গোপনীয়তা। যা কিছু গভীর গোপন, যা কিছু একান্ত ব্যক্তিগত, তারই আদল ধরে চিঠির অক্ষরেরা। প্রোমোশন লেটার হোক কি প্রেমপত্র, চিঠি মানেই গোপন। প্রাপক সেই গোপন বার্তা কারও সঙ্গে ভাগ করে নেবেন কি না, সে সিদ্ধান্তও তাঁর একান্তই ব্যক্তিগত। কিন্তু অন্য কেউ সেই গোপন দুনিয়ায় যেচে উঁকিঝুঁকি দেবেন না, এ সভ্যতারই শর্ত। যদিও সোশ্যাল দুনিয়ায় সব শর্তই ঘেঁটে ঘ। তাই একদিকে ব্যক্তিগত চিঠি মেলে ধরার জোয়ার, অন্যদিকে সেই চিঠি গোগ্রাসে গেলার হিড়িক।
কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না।
একা কর্নেল নন, সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে কর্নেলের ব্যাটেলিয়নে শামিল সকলেই। সময়ের ইঁদুরদৌড়ে পিছিয়ে পড়েছে চিঠির অপেক্ষা। আঙুলের এক ক্লিকে মেসেজ পাঠানোর যুগে কাজ হারিয়েছে ডাকঘর। টেলিগ্রাম কিংবা চিঠি মানে এখন সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপ। আসলে সোশ্যাল মিডিয়া ভারী আজব দুনিয়া। যা কিছু হারায়, তা নিয়েই সোশ্যাল মিডিয়ার জিয়া নস্টাল। চিঠি না-পাওয়ার মনকেমনও তাই এখানে ইদানীং কালে ট্রেন্ডিং। দিনকয়েক ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলেই দেখা যাচ্ছে, চিঠির বন্যা। আসল চিঠি নয় ঠিক, এও অ্যাপেরই কারসাজি। হাতের লেখা থেকে লেখার বয়ান, সবকিছুকেই আসলের মতো করতে অবশ্য চেষ্টার ত্রুটি নেই। সেই অ্যাপে নাম লেখালেই মিলতে পারে চিঠি, তবে বেনামে। কিন্তু চিঠি ব্যক্তিগত ইনবক্সে এলেও, তাকে খোলা ওয়ালে মেলে ধরাই সোশ্যাল মিডিয়ার দস্তুর। প্রাপক যেমন সেই গোপন ঘর হাট করে মেলে দিচ্ছেন সকলের সামনে, তেমনই সেই ঘরে যখনতখন ঢুকেও পড়ছেন যে কেউ। কে কাকে কী লিখলেন, তা পড়ে নিচ্ছেন গোগ্রাসে। বেনামি চিঠির কলম আসলে কার হাতে, তা আন্দাজ করার চেষ্টাতেও খামতি নেই। শুধু তাই নয়, কেউ কেন কোন কথা বলল- চিঠির নিচে তার খুল্লমখুল্লা বিশ্লেষণ। সব মিলিয়ে চিঠির গোপনতা আপাতত চণ্ডীমণ্ডপের খোরাক।
এতদিন মুখবন্ধ খামের নাম ছিল গোপনীয়তা। যা কিছু গভীর গোপন, যা কিছু একান্ত ব্যক্তিগত, তারই আদল ধরে চিঠির অক্ষরেরা। প্রোমোশন লেটার হোক কি প্রেমপত্র, চিঠি মানেই গোপন। প্রাপক সেই গোপন বার্তা কারও সঙ্গে ভাগ করে নেবেন কি না, সে সিদ্ধান্তও তাঁর একান্তই ব্যক্তিগত। কিন্তু অন্য কেউ সেই গোপন দুনিয়ায় যেচে উঁকিঝুঁকি দেবেন না, এ সভ্যতারই শর্ত। যদিও সোশ্যাল দুনিয়ায় সব শর্তই ঘেঁটে ঘ। সব ক্ষেত্রে সকলের অধিকার- এহেন গণতন্ত্র সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া আর কোনও দেশে এখনও পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। যদিও সে গণতন্ত্র গণের প্রতিজনের ব্যক্তিগত অধিকারের কথাই বলেছিল। তবে অত সূক্ষ্ম বিচারে কে আর যায়! তাই, ফোনের আলোয় পণ্য হল যা কিছু আজ ব্যক্তিগত। সেই যে থিওডর অ্যাডর্নো বলেছিলেন- দিচ্ছে তাই খাচ্ছি আর খাচ্ছে তাই দিচ্ছি-র চক্কর, সে কথা মিডিয়া থেকে সোশ্যাল মিডিয়া সর্বত্রই আজ ভয়াবহভাবে সত্য। আপনি যদি প্রশ্ন তোলেন, অন্যের ব্যক্তিগত চিঠির পরিসরে চোখ রাখছেন কেন? পালটা এই উত্তরই আসবে, যে, চোখের সামনে তো তা মেলেই ধরা হয়েছে।
আসলে সোশ্যাল মিডিয়া তো সবকিছু মেলে ধরতেই বলে। আপনার সাজানো বইয়ের তাক থেকে বেডরুমের গোপন কোণ, সবকিছুই সোশ্যাল মিডিয়ায় মেলে ধরাই যেন নিয়ম। ব্যক্তিজীবনে আপনি কী প্রশংসা পেলেন, এমনকি কোন কুৎসার মুখে দাঁড়ালেন, সেই সব কিছুর বিজ্ঞাপন সোশ্যাল মিডিয়ায় না করা পর্যন্ত যেন তা মান্য নয়। সভ্যতার ইতিহাস যত এগিয়েছে, গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার নিয়ে ততই সওয়াল করেছি আমরা। ব্যক্তি থেকে গোষ্ঠী- সকলের নিজস্ব পরিসর আর তার সীমা নিয়ে কথা বলেছি। অথচ, সেই আমরাই সোশ্যাল মিডিয়াকে গুরুত্ব দিতে দিতে ভুলে গিয়েছি গোপনীয়তার সীমা। সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যের জীবনে উঁকিঝুঁকি দিয়েই মেপে নিয়েছি তার থাকা না-থাকার হালহকিকত। আবার যে যেমন আছি, তা নিয়ে খুশি নই কিছুতেই। সোশাল মিডিয়া আমাদের কেমন রাখছে বা কেমন থাকতে বলছে, সেই চাপ যেন ক্রমাগত আমাদের পেড়ে ফেলেছে। ভারচুয়াল চিঠির এই ট্রেন্ড সেই দিকটিতেই আলো ফেলছে। প্রশংসার কথা, ভালো লাগার কথা সোশ্যাল মিডিয়ায় জাহির করা তো আছেই। আমার দিকে নজর টানতেই হবে, এই দেখনদারি সেখানে জেগে আছে পুরোদমে। পছন্দসই চিঠি না পেলে শেয়ার না করা, নতুন করে অ্যাকাউন্ট খোলা, কিংবা ‘আমার গুরুত্ব নেই’ বলে নিজের ওয়ালে দুঃখপ্রকাশ করা- এমন সব আচরণ দেখে আশঙ্কা হয়, আমাদের অস্তিত্ব কি সমস্তটাই দাঁড়িয়ে আছে সোশ্যাল মিডিয়ার স্বীকৃতি আর অস্বীকৃতির উপরেই?
কেবল তো প্রশংসার কথাই নয়। কুৎসা-অপমান-নোংরা কথার স্রোতও ভেসে আসছে যখন? দেখা যাচ্ছে, সেইসব চিঠি শেয়ার করে তার উত্তরে পালটা আক্রমণ শানাতেও ছাড়ছি না আমরা। বেনামে চিঠি লেখার সুযোগ খুলে দিয়ে নিজেরাই ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধে নেমে পড়ছি। তার মানে কি এই দাঁড়াচ্ছে না যে, অন্য কেউ আমাদের কী বলবে- সেই ছকও আসলে আমরাই তৈরি করে দিতে চাই? সেও কি একরকমের অসহিষ্ণুতারই পরিচয় নয়? আবার উলটো দিকে এ কথাও সত্যি যে, পরিচয় গোপন রেখে যা ইচ্ছে বলার সুযোগ উসকে দিয়েছে ভেতরের দাঁত-নখগুলোকে। নিজের ইমেজ রক্ষার দায়ে প্রকাশ্যে মানুষ তাও একরকম মুখোশ পরে থাকে। কিন্তু যেখানে ইমেজে আঁচ পড়ছে না, সেখানে তার যাবতীয় রিপু উজাড় করে দিতে বাধবে কেন! তাই বেনামি চিঠিতে ফুটে উঠছে ঈর্ষা-হিংসা-লালসার দগদগে ক্ষত। আর অন্যের জীবনের সেইসব ক্ষত তারিয়ে তারিয়ে দেখছি আমরা, কমেন্টে গিয়ে তুফান তুলছি চায়ের কাপে। যে মেঘনাদ আড়াল থেকে তির ছোড়ে, তার ভালো কিংবা খারাপ কথা নিয়ে আমাদের তো মাথা ঘামানোর কথাই ছিল না। সেখানে কেবল নিজের জীবনে নয়, অন্যের জীবনের মেঘনাদদের নিয়েও আমরা মাথা ঘামাচ্ছি। যৌথতা থেকে একলা ঘরের সফরে পৌঁছে গিয়ে এ আবার কোন অদ্ভুত গোষ্ঠীজীবনের দিকে হাঁটছি আমরা? ভালোবাসা নয়, পাশে থাকা নয়, কোনও বিকৃতির সূত্রে আমরা জুড়ে যাব- এমনই কোনও সমন্বয় কি আদৌ কাম্য ছিল আমাদের?
এমন নয় যে, অন্য কারও চিঠি কেউ কখনও পড়েনি। কিন্তু পত্রসাহিত্যের কথা যদি বাদ দিই, ব্যক্তিগত চিঠি পড়া সবসময়েই গর্হিত কাজেরই তকমা পেয়েছে। ব্যক্তিগত ডায়েরিতে ধরা থাকে একা মানুষের একক সংলাপ, কিন্তু দুজনের ব্যক্তিগত কথোপকথনের ভার বয়ে চিঠিও ঠিক তেমনই ব্যক্তিগত। মনে করা যাক না, ইন্দিরা দেবীকে চিঠির পর চিঠি লিখেছিলেন তাঁর রবিকাকা। কিন্তু ‘ছিন্নপত্র’ নামে যখন সেসব চিঠির সংকলন প্রকাশ পেল, তিনি কিন্তু বেছে দিলেন- কতখানি সামনে আনবেন কিংবা আনবেন না। এই সম্পাদনার বোধই তো মানুষের ব্যক্তিসীমাকে ধরে রাখে। তেমনই, আমার সামনে যাই আসুক, তার কতখানি দেখব বা দেখব না, শুনব কি শুনব না, প্রতিক্রিয়া দেব কি না- সেই নির্বাচন আর সম্পাদনাতেই মানুষের গড়ে ওঠা। অন্যের সমস্ত জীবনে দূরবিন ধরতে পারার অধিকারকেই আমরা একদিন গণতন্ত্র বলে চিনব, আমাদের যাবতীয় গড়ে ওঠার পথ কি এইখানেই শেষ হওয়ার কথা ছিল?