ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
প্রত্যেকের নিজস্ব একটা ছোটবেলা থাকে। আমারও ছিল। মা কপালের ডানদিকে অমাবস্যার চাঁদ এঁকে দিয়ে মাথায় ঝুটি বেঁধে গোপালঠাকুর করে স্কুলে পাঠিয়ে দিত। আমি তখন সাত-আটের দুরন্ত বাছুর। দুষ্টুমি করা তখন একটা হবি। জুটত শিক্ষকদের প্রহার। আর এই প্রহার থেকে বাঁচতে হলাহল মিথ্যা কথা বলা।
এমনই একটি দিন স্মৃতির আবছা পাতা থেকে বলি।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে বড় হচ্ছি। কত অজানা প্রশ্ন মনের মধ্যে জমা হচ্ছে। বলতে সাহস হয়নি। জীবনের প্রতি কত কৌতূহল। প্রেম শুনছি। কিন্তু জানি নিষিদ্ধ ফল। তবুও বান্ধবী হয়। এমন একটি লাল বান্ধবী গায়ে গায়ে থাকত। অন্যের নামে কুৎসা, নিন্দা, ভাব– লালের সঙ্গে শেয়ার করতাম। লাল অঙ্কে কাঁচা। নামতা ভুলে যেত। আমি মাঝেমধ্যে সংশোধন করে দিতাম। না জানলে বলে দিতাম।
তখন মিড ডে মিল ছিল না। পাউরুটি দিত দুপুরে। তাই লালের সঙ্গে ভাগ করে খেতাম।
খুব ফর্সা ছিল তাই ওকে লাল বলতাম। ভালো লাগত। প্রেম করবার জন্য মন ছিল কিন্তু কিছুদিন পরে জানলাম লাল মুসলিম, তাই এগোতে পারিনি। মনের সাধ মনেই থেকে গেছে। অঙ্ক না পারলে বলে দিতাম বলে লাল আমার জন্য বাড়ি থেকে টোপা টোপা পাকা কুল আনত। আমিও লালকে অঙ্কে ভীষণ সাহায্য করতাম। এটা পরে মাস্টারমশাই ধরতে পেরেছিল। মৃদু বকাও দিয়েছিলাম। আমি লালকে বললাম, তুই ভালো করে অঙ্ক শেখ। আমি আর বলতে পারব না। স্যার বুঝতে পেরে গেছে। আমাকে বকেছে।
পরদিন লাল আমার জন্য বাড়ি থেকে জিলিপি এনেছিল। আমি সব ভুলে গিয়ে আবার অঙ্ক বলে দিতাম। আমরা একসঙ্গে ছেলেবেলার বিভিন্ন খেলা খেলতাম। লাল বারবার জিতে যেত। আমি হেরে গিয়ে বলতাম,আর তোকে অঙ্ক বলে দেব না।
লাল কাঁদতে শুরু করত। আমার মনখারাপ করতো। পরদিন আবার লাল কিছু না কিছু আনত।
আমি আবার অঙ্ক বলে দিতাম।
এইভাবে লালের কাছে আমি খুব বিশ্বস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। অংকের উত্তর যা বলতাম, বিশ্বাস করে লিখে দিত। একদিন একটা সহজ অঙ্কের উত্তর ইচ্ছে করে ভুল বলে দিয়েছি। স্যার লালকে খুব বকল, মারল। শাস্তিস্বরূপ বলল, তোতন, তুই ওকে একশো বার কান ধরে উঠ বোস করাবি।
আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমার জন্য লাল এত বকা খেল,মার খেল। তারপর আবার একশো বার কান ধরে উঠবোস।
লালের কান্না দেখে আমারও কান্না এসে গিয়েছিল। ভয়ে কাঁদতে পারছি না। তবে এইভাবে গুনছিলাম,
এক, এগারো, একুশ, একত্রিশ,… একাশি, একানব্বই, আটানব্বই, নিরানব্বই… যেই বলেছি, স্যার পিছন থেকে পিঠের উপর সপাসপ বেতের বাড়ি।
আমি ‘বাবা গো, মা গো’ বলে চিৎকার করে উঠলাম।
স্যার বলল, তুই এবার একশো বার কান ধরে উঠবোস কর।
লালকে দায়িত্ব দিল গুনতে।
এই অপরাধ আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।
লাল, স্যরি।
আমি আর ইচ্ছে করে এই ভুল করব না।
আমি এখনো কান ধরে উঠবোস করছি।
আজও একশো হয়ে উঠেনি।
জীবনের নামতা যে বড্ড কঠিন। শুধু ধরা পড়ে যাই।
ভালো থাকিস। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে আমার দুষ্টুমিগুলো লাল রং করে নিস।