ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
পড়ন্ত দুপুর। রাঙা হয়ে আসছে রোদ্দুর। ঝিম ধরা দুপুরে ঘুমিয়ে আছে পাড়া, নির্জনতা চুরমার করে হেঁকে যায় ফেরিওয়ালা। রাস্তার ফেরিওয়ালার ডাকে বাড়ির বারান্দায় বেরিয়ে এসেছেন পাড়ার মানুষজন। নিঝুম দুপুরে ফেরিওয়ালার সুরেলা এই ডাকের অপেক্ষায় যেন ভাতঘুম এড়িয়ে অপেক্ষা করছিল সবাই। ঈষৎ আলস্য ও কৌতূহল তাঁদের ভঙ্গিমায়। কেউ সবেমাত্র স্নান সেরে ভিজে চুলে গামছা জড়াচ্ছেন, কারও হাতে চায়ের কাপ, কেউ বা তোশক-বালিশ রোদে দিতে ব্যস্ত। এ সবের মাঝখানে ফেরিওয়ালা স্ত্রী ও পুরুষ দু’দিক দিয়ে মেলে ধরেছে ফুল-পাতার নকশা সেলাই করা বড় একটি চাদর। মফস্সলের ইট-পাথরের ভিতরে সুদৃশ্য নকশাদার চাদরটি যেন এক টুকরো বাগানের আরাম।
সেদিনকার দুপুর, সেই চুপচাপ বেলা আজ আর নেই, নেই সেদেনের সেই ফেরিওয়ালা। নিউকোচবিহার স্টেশন থেকে ট্রেনের হুইসল ভেসে আাসছে। জোয়ারের জল তীরের পাথরের উপর আছড়ে পড়ছে। ভুটান পাহাড়ের গা ছুঁয়ে জোরালো উত্তুরে হাওয়া চামড়ায় কামড় বসাচ্ছে। ছেলেবেলা নিচু হয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। আবার সেই দুপুর, সোনালি বালির নদী, তরমুজের জমি এবং উপরে আকাশ, চিত্র-বিচিত্র সব মেঘ আর মাঠের নির্জনতা শৈশবের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
স্মৃতির ভিড়ে শেষ বিকেলের আলো ছুঁয়ে যাচ্ছে। তোর্ষার মাঝখানটিতে ছোট ঘুর্ণি পাক খেতে শুরু করেছে। ছড়িয়ে যাচ্ছে কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে। হারিয়ে যাওয়া শৈশববেলায় তাকিয়ে দেখি ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। আকাশের অবস্থা দেখে মানুষেরা দ্রুত ঘরে ফিরছে। রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে, শিলাবৃষ্টি হতে পারে, আকাশটা ক্রমে কালো হয়ে গেল। দুটো-একটা সাদা বক ইতস্তত উড়ে উড়ে নিরুদ্দেশে চলে যাচ্ছিল। খুব থমথমে ভাব। ডালপালা একটাও নড়ছে না। যত আকাশ কালো হচ্ছে, যত এই পৃথিবী ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে আামরা তত উল্লাসে ফেটে পড়ছি। কী উল্লাস, কী উল্লাস! ঘুরে-ফিরে নাচছি। আকাশ দেখে, পাগলপারা আকাশ দেখে যেমন খুশি হয়ে তালি বাজাই, ভুবনময় তালি বাজে— নেচে-নেচে তালি বাজাতে থাকি! টুপটাপ বৃষ্টি, গাছপাতা ভিজে যাচ্ছে।
বাইরে জোর বর্ষা। মাঝে মাঝে আকাশটা চিরে যাচ্ছে। ফালা ফালা আকাশে বিকট গর্জন— বাড়িতে একটা রেডিও ছিল। থাপ্পড় দিলে চলত। আবার থাপ্পড় দিলে বন্ধ হয়ে যেত। সেই রেডিও থেকে মেঘের পরে মেঘ জমেছে গানটি ভেসে আসছে। রান্নাঘর থেকে নদী দেখা যায়। রান্নাঘরের জানালায় মুখ রেখে ভুলু অনবরত ডাকছে। বাড়িটার উত্তরে মোত্রা ঘাসের জঙ্গল। এখন সেখানে নানারকমের কীটপতঙ্গ উড়ে বেড়াচ্ছে। দুটো গোসাপ ঝোপের ভিতর ঢুকে গেল। নদীর পাড় থেকে থেকে থেকে খেপ মারছে ঝালোপাড়ার সুজন, হাওয়ায় তার চুল উড়ছে। এখানেই কানাই এবং বুড়ি ডুবে মরেছিল। পাড় থেকে পাড়ে পাড়ে আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি। সুজন খেপলা জাল নিয়ে আরও দূরে চলে গেছে। আরও দূরে যাবে। আরও ঝেঁপে নামবে বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে তাবত জগৎসংসার আমি হাতড়ে বেড়াচ্ছি কাগজের নৌকা, ফিতা ক্যাসেট, জেনকিন্স স্কুল! লোডশেডিং-এর জন্য দেখতে না-পারা আালিফ লায়লা, চিত্রহার কিংবা সুরভীর দুঃখের মতন জেগে ওঠছে ছুটির ঘণ্টা।
সূর্যাস্তের আকাশ অদ্ভুতভাবে পরিষ্কার হয়ে উঠল এবং কিছুক্ষণের জন্য আকাশের একাংশে নীল আলো চলে গিয়ে ঝিনুকের মতো রং ধারণ করল। আকাশের শেষ নীল মিশে গেছে পৃথিবীর শেষ সবুজে। কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম, জানি না। ঘড়ির একটা ছবি আমার মাথার মধ্যে উড়ে এল। তার নিচে আমার শৈশব সেই সকাল সকাল জলরং নিয়ে বসে আছে। আমি আমাকে আঁকি। জলটিকে আঁকি। হারিয়ে যাওয়াকে আঁকি।