ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
প্রিয় স্মৃতিজাগানিয়া ছোটবেলা,
মেয়েবেলায় সুখ ছিল, সদ্য ফোটা গোলাপের যতটুকু থাকে। সহজ, নির্মল, ঝরঝরে। তাজা ফুলের মতো সময়টায় কেবল স্বপ্ন দেখতাম। সকলে যখন ডাংগুলি, এক্কা-দোক্কা, লুকোচুরি, কুমিরডাঙা আর কবাডির সবুজ উঠোনে নিজেদের ডানা খুঁজে নিচ্ছে, আমার তখন পরি হতে ইচ্ছে করত। এই ইচ্ছের গভীরতা টের পেয়েছিলাম আর-একটু বড় হতে। সেটা ছোট থেকে বড় হওয়া নয়। বড় হতে হতেও ছোট থাকার সময়ের কথা। বইয়ের পাতা, খাতার সমান্তরাল লাইন পেরিয়ে মন পরির মতো ডানা মেলে বেড়াত। আর নিজেকে বলতাম, আমি মনপরি হতে চাই।
নিশ্চয়ই খুব হাসছ! ভাবছ, সেই কবেকার অদ্ভুত, কিম্ভূতকিমাকার ইচ্ছেটা আমি মনে রেখেছি! তোমায় বোঝাতে পারিনি, আমি সকলের মনের কথা শুনতে পেতাম। এটাই সত্যি। স্কুলে সকলে যখন ‘কী হতে চাই’-এর গল্পে ডাক্তার, শিক্ষক-শিক্ষিকা বা খেলাঘরের রঙিন গুটি সাজাত; আমি ভাঙা পেনসিলবাক্স আগলে বসে থাকতাম। যে মেয়েটা ক্লাসে ডাক্তার হতে চায় বলে আলো কুড়োচ্ছিল, তার মন তখন বলছে “ইস! তিতকুটে ভৌতবিজ্ঞান পড়তে হলে ডাক্তার হতে চাই না।” সেদিন ক্লাসের পর মেয়েটাকে বলেছিলাম, “তুই আসলে পাখি হয়ে উড়ে বেড়াতে চাস, তোর ইচ্ছে প্লেন ওড়াবি, তাহলে মিথ্যে কেন বললি!” মেয়েটা আমার চুল টেনে দিয়েছিল।
দুদিকে বিনুনি দুলিয়ে একটা ছাইরঙা খাতা নিয়ে যে মেয়েটা রোজ ক্লাসের পর আমাদের কয়েকজনকে পড়া বোঝাত, যে সেদিন শিক্ষিকা হতে চাই বলে আনন্দ পাচ্ছিল, সেই মেয়েটা বাড়িতে রোজ বকুনি খেত পড়ার বইইয়ের নিচে আঁকার খাতা রাখত বলে। আমি ওর ক্লাসের খাতায় লিখে দিয়েছিলাম, “ভূগোলের বিচ্ছিরি পাহাড়গুলোর থেকে তোর আঁকা পাহাড় বেশি সুন্দর।” তারপর ও আর কোনও দিন আমায় ওর খাতা দেখায়নি। আমার কী দোষ ছিল! মনের কথা শুনতে পাওয়াটা আমার ভুল!
আমি কাউকে বোঝাতে পারিনি ভাঙা পেনসিলবাক্সের ভেতর ভাঙা মন জমাতাম। সকলের কান্না-ধোয়া মন আমি রেখে দিয়েছিলাম। আমি সকলের মনের অসুখ সারাতে চাইতাম। বাবা যতদিন আমার ওই পেনসিলবাক্সটা দেখতে পায়নি, আমি ওটা আগলে রাখতে পেরেছিলাম। আমি ওটায় মায়ের নামও লিখেছিলাম। মা ভালো ঘর সাজাত। ফুল, ছবি বাবা এনে দিত। মায়ের মনের কথা শুনতে পেয়েছিলাম। মা সকলের ঘর সাজাতে চাইত। মুখ ফুটে বলেনি কোনও দিন। মায়ের কাছ থেকে আমমাখা খেতে খেতে চুপিচুপি প্রশ্ন করেছিলাম, “তুমি বুঝি চাকরি করতে চেয়েছিলে মা? ইন্টিরিয়ার ডিজাইনিং?” মা ঠক করে কাচের বোতলটা সামনে বসিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল। বাবা সেদিন আমায় আর মাকে দেখতে পেয়ে গিয়েছিল। আমার সেই ভাঙা পেনসিলবাক্স গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়। সব নাম লেখা চিরকুট হাওয়ায় উড়ে গিয়েছিল সেদিন। আমার ‘মনপরি’ হয়ে ওঠা হয়নি। পড়ার বিষয় পছন্দ করার সময় সাইকোলজি বা মনোবিদ্যা শব্দটা উচ্চারণও করতে পারিনি। আমার ওই ভাঙা পেনসিলবাক্সটাই তো আর ছিল না! জগদ্দল পাথরের মতো বই-খাতার ঘানি টেনেছি শুধু।
আমি কিছু হতে পারিনি। আসলে তোমায় নিজের চোখে ক্ষতবিক্ষত হতে দেখার পর কিছু হওয়ার ইচ্ছেটাই মরে গিয়েছিল। আমার ছোটবেলা মানে তোমার সেই পালকহীন, ডানাকাটা পাখির মতো রূপটা অসহ্য লাগত। তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গিয়েছিলাম। ভাঙা পেনসিলবাক্সের কথা মনেও রাখতে চাইনি। শুধু একটা চিরকুট আজও জমিয়ে রেখেছি। তাতে লেখা ‘ছোটবেলা’। আমি তোমার মনের কথা পড়তে পেরেছিলাম। কিন্তু তোমায় একটা কাঙ্ক্ষিত ‘মেয়েবেলা’ উপহার দিতে পারিনি। আজ ওই চিরকুটটাকে লম্বা পাতায় আটকে এই চিঠিখানা তোমায় পাঠালাম। ভেবো না আমি তোমায় কোনও দিন ভুলে গিয়েছিলাম। নিজের ভেতর এক টুকরো টলটলে জলের কুয়োর মতো আজও আগলে রাখি তোমায়। আমি তোমার ইচ্ছেমতো ‘মনপরি’ হতে পারিনি। আমায় ক্ষমা কোরো।
ইতি
ডিপ্রেশনে ভোগা, অসুখ করা বড়বেলা