ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
প্রিয় ছেলেবেলা,
কেমন আছিস? আমিও মোটামুটি আছি। হ্যাঁ, তুই শুনলি বলবি জানি, যে, আমি এখন ডি লা গ্রান্ডি আছি! কিন্তু বিশ্বাস কর, ট্রাফিকে একঘণ্টা আটকে গাড়ি চালিয়ে সেই মজাটা নেই যেটা তখন দুহাত ছেড়ে সাইকেল রেসে ছিল। এখানে ফুচকা অগ্নিমূল্য! মনে পড়ে বগাকাকুর কাছে পাঁচ টাকার ফুচকা খেলে এমনিতে দুটো ফুচকা ফাউ তো থাকতই, তার উপর একটা ট্যাপা ফুচকা আচার মাখিয়ে দিতে হত আমাদের স্পেশাল ডিমান্ড বলে। আজকাল না ছোটরাও আর ফাউ চায় না।
তবে এখন কিন্তু ক্রিকেটের রমরমা! মনে আছে সেই শারজা মরুঝড়? আমরা সবাই রনিদাদের বাড়ি বসে খেলা দেখেছিলাম সেবার। তখন সবার বাড়িতে কোথায় কেবল? গুহজেঠু ম্যাচ শেষে রাত একটার সময় বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল। সারা রাস্তা শচীনের শ্যাডো করতে করতে ফিরেছিলাম। সে কী আনন্দ! আজকাল ভারত বেশ ভালো খেলছে, কিন্তু জানিস আজকাল সবাই তাদের মোবাইল ফোনেই খেলা দেখে। আজকাল কেউ কারও বাড়ি গিয়ে বা ক্লাবে বসে খেলা দেখে না, সবাই যে যার নিজের মতো দেখে। তবে এখন আর অ্যান্টেনার ঝামেলা নেই। মনে আছে, একদিন ঝড় হলেই পরদিন ছাতে উঠে সে কী কসরত অ্যান্টেনাকে নিয়ে! নিচ থেকে মা চিৎকার করত, এখনো হয়নি, ছবি আসছে না! সে কত না হাতে পায়ে ধরে সেই অ্যান্টেনার মানভঞ্জন করতে হত। আলাদাই রেলা ছিল কিন্তু অ্যান্টেনার তখন! লাইভ ক্রিকেট ম্যাচ থামিয়ে দিত একটা কাকের উপর রাগ করে, আর ঝড় হলে তো কথাই নেই।
ঝড় বলতেই মনে পড়ল, জানলায় বসে হাত বের করে বৃষ্টি ভিজতে কী মজা লাগত! আর মা কী বকাটাই না দিত! বৃষ্টির ছাঁটে যে বিছানার চাদর ভিজে যাবে। আর সেই শিলাবৃষ্টির পর বেরিয়ে শিল কুড়িয়ে আনা? কী বোকা ছিলাম আমরা ভাবো তো, আজকালকার বাচ্চারা শুনলেই হাসবে। তবে রেষারেষি করে ঝড়ের পরে আম কুড়োতে যাওয়ার একটা আলাদা উত্তেজনা ছিল, যাই বলো! ঝড় ঠিক শুরুর দিকে তোর মনে পড়ে, একটা অদ্ভুত মন কেমন করা গন্ধ উঠত মাটি থেকে! জানিস, আজকাল ওই গন্ধটা আর পাই না! এই বদলে যাওয়া সময়ের বুকে ওই গন্ধটাও বোধহয় কোথাও হারিয়ে গেছে। হারিয়ে যাওয়া বলতে মনে পড়ল, চুইংগামের সঙ্গে তখন একটা করে ক্রিকেটারদের কার্ড ফ্রি দিত মনে আছে? প্রতিটা চুইংগামের প্যাকেটের ভিতরে রান লেখা থাকত। সেই রান জমিয়ে ১০০ রান করতে পারলেই, ক্রিকেটারদের ছবি-দেওয়া একটা ডায়রি দিত। সেটাই ছিল আমার সাত রাজার ধন! আর সেটাই কিনা হারিয়ে ফেললাম! পরে বুঝেছিলাম বাবি আসলে আমার থেকে ওটা চুরি করে নিয়েছিল।
অবশ্য চুরি করার কথা বললেই মনে পড়ে সেই সরস্বতী পুজোর কথা! মনে আছে তোর? সারারাত জেগে প্যান্ডেল বানানো? গ্রামের মন্দির, উপরে খড়ের চাল দেওয়া! সেবার আমরা যে হারে ফুল চুরি করেছিলাম, পাড়ার সকলে পরদিন সকালে হাহুতাশ করেছিল। বিলুটা এত মাথামোটা যে লাহিড়ী জেঠুর ফ্লাওয়ার শো-তে প্রাইজ পাওয়া ক্যাকটাসটাও কিনা তুলে এনেছিল? সকালে জেঠু ঠিক ধরেছেন। তখন আমি বলেছিলাম, কিছুক্ষণ আগে আমরা একটা লোকের থেকে ওটা কিনলাম ১০০ টাকা দিয়ে। জেঠু বলেছিলেন পুজোর পর ফেরত দিয়ে দিতে আর উলটে আমাদের ১০০ টাকা দিয়ে দিয়েছিলেন। সেদিন যতই আনন্দ করে থাকি, আজ বুঝি জেঠু আসলে বুঝতে পেরেছিলেন আমাদের মিথ্যে কথাগুলো।
আজকাল জানিস, আর লোডশেডিং হয় না? রাতে নিয়মিত পড়া থেকে দু-ঘণ্টার ছুটি হয় না, বাড়ির চাতালে বেরিয়ে পাশের বাড়ির বন্ধুর সাথে গল্প হয় না, অকারণ হাসি হয় না, অন্ধকারে ঘটিগরম ডাক শুনে শিহরিত হওয়া হয় না! আসলে আজকাল চারদিক বড় আলোকিত, বড় বিলবোর্ডের উপর সর্বক্ষণের হ্যালোজেন ঝলসানির ঠেলায় বহুদিন রাতের তারাভরা বিস্তীর্ণ আকাশ দেখা হয়নি, জ্যোৎস্নার আলোয় স্নান করা খেলার মাঠে বসে আর কিছুক্ষণ গল্প না করার জন্য বড় আপসোস হয়। আরও একটু দেরি করে কারেন্ট এলেই পারত, আজ সেই অন্ধকার আকাশটা দেখতে বড় মন চায়। তাই বলছি বড় হওয়ার জন্য একদম তাড়াহুড়ো করিস না। দুচোখ ভরে দেখে নে ওই আকাশটা, বৃষ্টি ভিজে নে, জ্যোৎস্না মেখে নে, কাদায় ফুটবল খেলে নে, মনের সুখে চুরমুর, ঘটিগরম খেয়ে নে… বড় হলেই তো…