ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
৯ বছরের তনি,
জানিস আমি এখন আর জাদুতে বিশ্বাস করি না! মানে ধর এমন কোন বছর, যখন একটু অন্য রকম হাওয়া দিল, মানুষ হয়তো একটু বেশি ভালবাসতে শিখল। হয়তো সেবছর সবাই একটু সাবধানে গাড়ি চালাল, পথে কুকুরছানা পড়ে গেলে কোলে নিয়ে আদর করল খানিক। একটা, জাস্ট একটা বছর রেশনে পাওয়া কেরোসিনগুলো শুধু রান্নার কাজেই লাগাল। তোর এই ন’বছরের জীবনে দেখেছিস এমন কোনও বছর? আমি দেখিনি জানেন! ছোট থেকেই আমাদের চোখে রক্তের কালচে লাল রঙটা বড্ড সয়ে গেছে।
অথচ তোর বয়সে কত বিশ্বাস নিয়েই না সব কিছু করতাম। আসানসোলে পি.সি সরকার এলে, তর্জনীর ওপর মধ্যমা জড়িয়ে নিয়ে খুব করে চাইতাম এবার একটা অন্যকিছু হোক। সেই যে বিকেলে হোঁদলার মতো কয়েকজন গর্ত খুঁড়ে ঢুকে যেত গুটলি মেরে। খুব জোরে জোরে শ্বাস ফেলত। ভারি কষ্ট পাওয়া চোখে তাকিয়ে থাকত আকাশের দিকে। তারপর রাতে কী যে হত! শুধু সকালে দেখতাম ক’টা তুলোর বল এসে পড়ে আছে মাটিতে, আর হোঁদলা পরম যত্নে সারাদিন ধরে তাদের গায়ে জিভ বুলিয়ে চলেছে। এই সময় কেউ কাছে গিয়ে দেখাক তো দেখি!
আমার কথা অবশ্য আলাদা। বাড়ির লোকের আবার ভিজিটিং আওয়ার্স কী? একদম কাছে বসে হোঁদলার মাথায় হাত বোলাতাম আর গুনতাম রোজ। কমে যাচ্ছে না তো?
তারপর একদিন খুব ভোরে, পি.সি সরকার শহর ছাড়ার আগে চোখ এঁকে যেতেন উলের বলে। কী মায়াটাই না ছিল সেই তুলির রঙে! থ্যাবড়া নাকখানা এনে হাত শুঁকত প্রথমে, তারপর জামার হাতাটা মুখে ভরে শুরু হত টানাটানি। কী অদ্ভুত না! কত অল্পতেই ভালবেসে ফেলা যায়! আমরা কেন পারি না বল তো?
মাঝে মাঝে বড় ভুলভাল জায়গায় বাচ্চা দিত হোঁদলা। তখন চলত বাড়িবদল পালা। আমার এখনও মনে পড়ে বেশ– আমি দু’হাতে দু’জনকে নিয়ে হাঁটছি, আর হোঁদলা আসছে পিছন পিছন। মাঝে মাঝে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আমার পেটের উপর ভর দিয়ে দেখে নিচ্ছে ছানা দুটোকে। আর ওর লম্বা জিভ দুটোরই মাথা ছুঁয়ে যাচ্ছে একবার করে।
তারপর আরেকটু চলতে শিখলেই ধপাধপ নালায় পড়ত সবাই। প্রথম দিকে হোঁদলাই তুলত, তারপর আরেকটু ভারী হলে আমাকেই ছুটতে হত হাতা গুটিয়ে।
একদিন এক ‘ভদ্রলোক’কে নালা থেকে তুলে ভীষণ ঝাড় দিচ্ছি। তো সে দেখি বকা খেতে খেতেই দিব্যি বালিতে ডিগবাজি খেয়ে স্নান সেরে ফেলল। তারপর আমার প্যান্টের কোনা ধরে টানতে লাগল যত জোরে পারে। আমি ফ্রাস্ট্রেটেড বক্তা ফেরার পথ ধরলাম। ছানাটাও প্রায় আমার প্যান্টের সঙ্গে ঝুলতে ঝুলতে চলল বাড়ির দিকে।
বাড়ি মানে, টাইগারের জমিদারিতে ঢুকে তাকে কষে একটা সেলাম ঠুকল প্রথমে। তারপর টাইগারের লেজ ধরে ঝুলে পড়ল। আর সেই যে ঝুলল তারপর থেকে শেষ দিন অব্দি টাইগারের লেজের প্রতি তার প্রেম ছিল লিখে রাখার মতো। বড় লেজপ্রেমী বালক ছিল আমাদের নেংটি। মারদাঙ্গার সময়ও শুরুতেই প্রতিপক্ষের লেজে কামড় বসাত, তারপর অন্যকথা।
তারপর একদিন… না আজ থাক, অন্যদিন হবে। আসলে কী বল তো, ভারি বাঁধা পড়ে গেছি। জানি তো কষ্ট পাবি। এভাবেই কতজন যে মায়াভরা চোখ নিয়ে এল, ভোঁতা ভোঁতা নাক ঘষে আদর খেল, কত দৌড়ল, কত কী শেখাল আর আমাদের কোলের ওপরই কত ধুকপুক একদম বন্ধ হয়ে গেল! ঠিক খেলনার মতো! ব্যাটারি শেষ হলেই কেমন যেন থেমে যায়! কর্পোরেশনের লোক কাঁধে তুলে নেয় বস্তায় ভরে। আচ্ছা ওরা কি সরকারি মেকানিক? কারখানায় নিয়ে গিয়ে ব্যাটারি বদলে দেয়?