ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
প্রিয় ছোটোবেলা,
কেন যে তোমাকে ‘প্রিয়’ সম্বোধন করছি, কে জানে! চিঠি লেখার চিরাচরিত নিয়মের অভ্যেসে, নাকি ভদ্রতায়? কারণ অতীতে তুমি তো আমার খুব পছন্দের ছিলেই না কখনও! একটিমাত্র সন্তান হওয়ার শতেক জ্বালা! মা-বাবারা উঠেপড়ে লেগে পড়েন তাঁদের এতদিনের সমস্ত অপ্রাপ্তির হিসেব কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নিতে। আর বাকি গুরুজনরা হয়ে ওঠেন স্বঘোষিত অভিভাবক। আমিও পড়েছিলাম সেই জাঁতাকলে। শাসনে হাঁসফাঁস করতে করতে সমবয়সী বন্ধুর অভাব পূরণ করতে প্রথমে সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম দক্ষিণের বারান্দার রেলিংগুলোকে, আর তারপর আমার পুতুলদের। ভারী বাধ্য ছিল এরা। সাত চড়ে রা কাড়ত না। আমাকে যেভাবে শাসন করা হত, তোতাপাখির মতো বুলি আওড়ে এদেরও ঠিক সেইভাবেই দাবিয়ে রাখতাম আমি।
আর একটু বড়ো হলাম যখন, আবিষ্কার করলাম সেভাবে বন্ধুবান্ধব না থাকলেও চলে… যদি একা থাকার বাধ্যবাধকতাকে ‘দুর্বলতা’ না মনে করে নিজের ‘শক্তি’ বলে ভেবে নিতে পারা যায়। কিন্তু শক্তি অর্জন করতে গেলে হাতিয়ার প্রয়োজন। সেই হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল আমার বই। ছোটোবেলা থেকেই এই একটি সোনার সুযোগ সব সময়েই পেয়ে এসেছি… অপর্যাপ্ত বই পড়ার সুযোগ। বাড়ির বড়রা হয়তো ভেবেছিলেন, এভাবেই শিশুটিকে বা পরবর্তীকালে বালিকাসুলভ চঞ্চলতাকে ভুলিয়ে রাখা যাবে। তাঁদের নিরাশ করিনি। বইয়ের সঙ্গে সই পাতিয়েছিলাম। আমাদের বাড়িতে বই কেনা হত বিস্তর আর বইয়ের ঘরে কোনও চৌকিদার ছিল না। তাই বুঝি বা না-বুঝি, গোগ্রাসে গিলতাম রাশি রাশি অক্ষরমালা। বড়দের বই, ছোটদের বই… সব! মার্কামারা যত ছোটদের বই পড়ে সাড়ে আট বছর বয়সে যখন প্রথমবার রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ হাতে নিলাম, জীবনে প্রথম বন্ধু পেলাম একজনকে। চারুলতা। মনে হল, আমি একাই ‘একা’ নই! চারুও আমার মতোই ভারী ‘একা’! চারুর তবু ‘অমল’ ছিল, আমার কোনও অমল ছিল না। আমার কোনও ‘অমল’ ছিল না বলাটা হয়ত ঠিক হল না; আসলে চারুলতা এসে আমার হাত ধরার আগে আমি নিজেই ‘অমল’ ছিলাম। ডাকঘরের অমল। টাইফয়েডে ভুগে ভুগে পাখির ছানার মতো ‘চিঁ চিঁ’ করতাম, জানলার পাশের খাটে শুয়ে শুয়ে একফালি নীল রুমালের মতো আকাশ দেখতাম আর আমার ‘সুধা’ হয়ে উঠেছিল ফুলে ফুলে ভ’রে ওঠা মাধবীলতা। সেই যে না-মানুষদের সঙ্গে একলাযাপনের স্বভাব, আজও তা বদলাল না! কী অদ্ভুত, না? মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে একটু পরেই ক্লান্ত লাগে, কথা ফুরোয়; কিন্তু একা একা অন্তহীন কথোপকথন!
রক্তমাংসের সঙ্গীর অভাবে ছোটবেলা যদি আচ্ছন্ন থাকে কল্পলোকের গল্পকথায়, তাহলে টেরই পাওয়া যায় না ঠিক কখন অন্যমনস্কভাবে ‘ছোটোবেলা’ নামের সেই ছোট্ট কুঠুরির নিচু চৌকাঠ পেরিয়ে পা রাখার সময় আসে ‘বড়োবেলা’র চবুতরায়। যতক্ষণে তা বুঝলাম… ছোটোবেলা, তুমি দেখলাম নিঃশব্দ পায়ে চলে গেছ অন্য কোনোখানে… শুধু তোমার পাঁচমিশেলি গন্ধটুকু রয়ে গেছে আমার অস্তিত্বে; ধূসর মেঘের আচ্ছাদন হয়ে। সে-মেঘে মিশে আছে ঠাম্মার হাতের ক্ষীর-কমলার মিঠে সুঘ্রাণ, দিদুর শরীর থেকে ভেসে আসা বসন্তমালতীর সুরভি, দাদুর তর্জনী আর মধ্যমায় ধরে থাকা জ্বলন্ত চারমিনার সিগারেটের কটু গন্ধ আর বাবার কিনে আনা নতুন গল্পের বই থেকে উঠে আসা রোমাঞ্চের টক-ঝাল-মিষ্টি আর ঝাঁজালো ভারী অন্যরকম এক সৌরভ।
এভাবেই বড় হয়ে যাওয়া। বুঝতে শিখলাম, বড়বেলার প্রাঙ্গণের বিস্তার সত্যিই বেশি! এ-মাথা ও-মাথা নজরে পড়ে না। কিছুদিন পরে পরেই মনে হয় পৌঁছে গেছি, ছুঁয়ে ফেলেছি প্রান্তরেখা… কিন্তু তার পরেই দেখি সীমান্ত সরে সরে যাচ্ছে ক্রমশ… দূর থেকে আরও আরও দূরে।
আর তখনই অবচেতনে তুমি কিছুটা হলেও হয়তো আমার কাছের, আমার ‘প্রিয়’ হয়ে ওঠো। কারণ তখন অনুভব করি, আমার ওই ছোট্ট ঘরই ভালো ছিল! ছুটোছুটি করে অন্তত সীমারেখাটুকু স্পর্শ করা যেত। আর হয়তো সেই কারণেই আজ এই চিঠি, এই সম্বোধন।