এ সময়, এ সমাজ জুড়ে জেগে থাকে একটাই প্রশ্ন- তুমি কোন দল? কেউ সোচ্চারে পক্ষ নেয়, কেউ এড়িয়ে যায়, কারও হাতিয়ার অজুহাত। অথচ এসবের বাইরেও তো পথ থাকতে পারে। নিজের নাটকে যে পথ একরকম করে দেখিয়েছিলেন মনোজ মিত্র। উত্তাল সময়ের আঙিনায় সমকালীন শিল্পীরা যখন ব্যক্তির রাজনৈতিক বিশ্বাসকে শিল্পের পরতে পরতে বুনে দিচ্ছেন, সেখানে মনোজ মিত্রের নাটক প্রকাশ্যে কোনও পন্থা ধরে মঞ্চে পতাকা পুঁতে দেয় না, অথচ মান্য করে শিল্পের রাজনৈতিক সত্তার প্রতি দায়বদ্ধতাকেও। মনোজ মিত্রের সেই রাজনীতিকে খতিয়ে দেখলেন অর্পণ দাস।
শিল্পীর সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক কতটা গভীর? প্রশ্নটা চিরপুরাতন হয়েও চিরনতুন। আজও উত্তাল সময়ের আঙিনায় কেউ ঝড়ের বেগে দরজা খুলে দেন। কেউ-বা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে জনপ্রিয়তার জল মাপেন। ব্যক্তি আর শিল্পীর সীমারেখা অস্পষ্ট হয়ে যায় উন্মুখ জনতার কাছে। আর যিনি উচ্চকিত না হয়েও শিল্পকে সুচারুভাবে ব্যবহার করেন? যিনি স্লোগানের ভাষা সরিয়ে রেখে তুলে ধরেন সমাজ-রাজনীতির বহুমুখী স্বরকে?
মনোজ মিত্রর নাট্যচর্চার দুনিয়া সেই অসম্ভবকে ধরে ফেলে অনায়াসে। আর সেটা কোন সময়ে দাঁড়িয়ে? যখন উৎপল দত্ত নিজেকে ‘প্রোপাগান্ডিস্ট’ বলে দাবি করেন। যখন শম্ভু মিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে সফোক্লেস হয়ে চাঁদ বণিকে খুঁজে ফেরেন ‘অন্ধকারের রাজা’কে। সেখানে অনুজ মনোজ মিত্রের নাটক প্রকাশ্যে কোনও পন্থা ধরে মঞ্চে পতাকা পুঁতে দেয় না। আবার শিল্পের রাজনৈতিক সত্তার প্রতি দায়বদ্ধতাকেও কোনওভাবে অস্বীকারও করে না।
অথচ কাদা মাটির আলতো স্পর্শ ছুঁয়ে বাদামী, বাঞ্ছাদের তিনি পৌঁছে দেন সমকালীন রাজনৈতিক বৃত্তে। কিংবা পুরাণ কাহিনি নিয়ে বার্তা দেন অশ্বত্থামা বা নরক গুলজারে। না, তাদের মুখে গণসংগ্রামের বুলি নেই। তাদের বক্তব্যে নেই বজ্রনির্ঘোষের আগাম সচেতনতা। শুধু মনোজ মিত্র সময়কে যে দাঁড়িপাল্লায় মাপেন, সেই বলিষ্ঠ মতাদর্শের বাহক হয়ে ওঠে চরিত্রদের কণ্ঠস্বর। অথচ ‘চাক ভাঙা মধু’ নাটকের বাদামীর কাছে সুযোগ ছিল অত্যাচারী অঘোর ঘোষের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার। শ্রেণিশত্রু অঘোরকে প্রাণে না বাঁচালে কি খুব অন্যায় করত বাদামী? তার সঙ্গীরাও তো সেটাই চেয়েছিল। সাপে কাটা অঘোরের মৃত্যুর কারণ হত বিধির বিধান। তবু তাকে প্রাণে বাঁচায় গর্ভবতী বাদামী। প্রাণের মূল্য তার থেকে ভালো আর কে জানবে? তার শরীরেও যে তিলতিল করে বেড়ে উঠছে ভবিষ্যতের আহ্বান। শ্রেণিশত্রুকে শেষ আঘাত করার কলঙ্ক নবজাতকের রক্তের সঙ্গে জড়িয়ে দিতে চায়নি বাদামী। ১৯৬৯ সালের সেই উত্তাল সময়ে মনোজ মিত্র রাজনৈতিক শত্রুতার বদলে বেছে নিয়েছিলেন প্রাণের স্পন্দনকে।
ঠিক সেই প্রাণের ডাকেই মরণ চেয়েও বছরের পর বছর বেঁচে থাকেন ‘সাজানো বাগান’-এর বাঞ্ছা কাপালি। মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে এসে সে গাছে ফুল ফোটায়। ঘাসে ঘাসে বুনে দেয় প্রাণের অব্যক্ত আকুতি। আলগোছে বাঞ্ছা হেঁটে বেরোয় বহুযত্নের চারণভূমিতে। মাটির গন্ধ পায়, তার শরীর বেয়ে ওঠে শ্যাওলার সবুজ নিবিড় স্পর্শ। মন চায় হৃদয়ের সঙ্গোপনে তার রূপ-রস ধরে রাখতে। বলতে ইচ্ছে করে, ‘মাটি বলে আমারে সাজাও… নিষ্কাম সাজাও’। অথচ এক দৃঢ় রাজনৈতিক বক্তব্যের বাহক এই নাটক। ছকড়ি, নকড়ি হয়ে হোঁৎকা-কোঁৎকা, ধরা পড়ে বাংলার গ্রামীণ অর্থনীতির বদলে যাওয়া এক রূপ। মৃত ছকড়ি দত্ত যদি সামন্ততন্ত্রের প্রতিনিধি হন, তাহলে নকড়ি ক্ষয়িষ্ণু জোতদার। আর হোঁৎকা-কোঁৎকা পার্টিতন্ত্রের শক্তিতে বলীয়ান। তাদের বিরুদ্ধে একা লড়ে যায় বাঞ্ছা কাপালি। সম্বল বলতে একটা ছোট্ট লাঠি। আর এক আকাশ ভর্তি বেঁচে থাকার আকুতি। শেষবেলায় ঘর থেকে ভেসে আসে নবাগতের ক্রন্দন। বাঞ্ছার গল্প চলতে থাকে যুগের পর যুগ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম। কল্পনা থেকে বাস্তব হয়ে ওঠে বাঞ্ছা, বাস্তবে থেকে হয়ে ওঠে রূপকথা।
অথচ এই মনোজ মিত্র সিনেমার জগতে একেবারে চেনা খলনায়ক। চোখের কোণে হিংস্র লোলুপতা, চলনে-বলনে ধূর্ততা। আশ্চর্যের বিষয়, তাঁর অধিকাংশ খলচরিত্রই রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে নয়। আট-নয়ের দশকের বিশ্বস্ত প্রতিনিধি হয়ে ওঠে তার চরিত্ররা। উঠতি বড়োলোক থেকে গ্রামের জমিদার, আবার কখনও তিনি নেহাতই স্তাবক। স্বার্থের জন্য অন্যায় কাজে যার জুড়ি নেই। প্রেমে বাধা দেন, হাতিয়ে নেন গরিব মানুষের সম্পত্তি। নায়ক এসে উদ্ধার না করলে, তারাই তো সমাজের মাথা। কাকতালীয় হতে পারে, তবু সিনেমার অভিনয়ে মনোজ মিত্র যেন না চেয়েও সমাজসচেতন।
সময় ভেসে যায় কপোতাক্ষ জলে। বদল আসে রাজনীতির সমীকরণেও। আমরা-ওরার ধারাপাত আজ স্পষ্ট চোখে আঙুল দাদা। সোশাল মিডিয়ায় প্রতি মুহূর্তে প্রশ্ন করে, ‘তুমি কোন দল?’ কেউ সোচ্চারে পক্ষ নেয়, কেউ গা ভাসায়। অনেকে আবার পরে নিয়ে আসে একগুচ্ছ অজুহাত। তার বাইরেও তো পথ থাকতে পারে। মানুষের অবস্থান কোনও পক্ষের ব্যানারে না থেকেও তো স্পষ্ট করা যায়। সেটা করতে গেলে আক্রমণ আসে সব পক্ষ থেকেই। গুলিয়ে দিতে চায় সত্য-মিথ্যার ব্যবধান। এই অসময়ে সেই লড়াইয়ের শক্তিটুকু দিও। মরণকে শ্যামসমান বলে অমর হয়ে ওঠার সাহস দিও বাঞ্ছা কাপালি।