অনেকে বলেন, দুর্গাপুজোয় একবার কলকাতা এলে বারবার আসার ইচ্ছা হবে। জগদ্ধাত্রী পুজোয় একই কথা চন্দননগর বা কৃষ্ণনগরের সঙ্গে যায়। তবে এই পুজোয় কলকাতা একেবারে নেই বললে ভুল হবে। এই শহরেও রয়েছে কিছু বিখ্যাত জগদ্ধাত্রী পুজো। কোথায় জানেন? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
আলোর শহর চন্দননগর। সেখানকার জগদ্ধাত্রী পুজোর জগৎজোড়া খ্যাতি। কম যায় না কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজোও। পুজোর ধরণ আর দিনক্ষণের হিসাব আলাদা হলেও, এই দুই শহরের মধ্যে জোর টক্কর চলেই। এসবের মাঝে কলকাতা কোথায়? আছে আছে, কলকাতার জগদ্ধাত্রীও কিছু কম যান না। বারোয়ারী তো বটেই, তিলোত্তমার একাধিক বনেদি বাড়িতে ঘটা করে আয়োজন হয় জগদ্ধাত্রী পুজোর।
পণ্ডিতদের মতে, দেবী জগদ্ধাত্রী আসলে দেবী চণ্ডীরই এক রূপ। বাংলার পাল-সেন যুগের বিভিন্ন তন্ত্র গ্রন্থেও সিংহবাহিনী জগদ্ধাত্রী পুজোর উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘মায়াতন্ত্র’ মতে, কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দিনের শুরুতে মধ্যাহ্নে এবং সায়াহ্নে জগদ্ধাত্রী পুজো করা যায়। অষ্টাদশ শতকের বাংলায় এই পুজোকেই প্রায় দুর্গাপুজোর বিকল্প করে তোলেন নদিয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র। শোনা যায়, দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়েই এমনটা করেছিলেন তিনি। প্রচলিত কাহিনি জানায়, বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব তখন আলিবর্দি খাঁ। নবাবের খাজনা মেটাতে না পারায় কারাগারে বন্দি হয়েছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। সালটা ১৭৫৪। শোনা যায়, সময়টা ছিল দুর্গোৎসবের কাছাকাছি। মুক্তি পেয়ে যেদিন নৌকায় ফিরছেন কৃষ্ণনগরে, সেদিন বিজয়া দশমী। নিজে দুর্গাপুজো করতে পারলেন না, এই কষ্টে কাতর হয়ে পড়েছিলেন রাজা। আর সেই সময়েই নাকি তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন দেবী তাঁকে বলছেন আগামী কার্তিক মাসের শুক্লানবমী তিথিতে তাঁর পুজো করতে। এই দেবী রক্তবর্ণা, চতুর্ভুজা, সিংহবাহিনী। ইনি জগতের পালনকর্ত্রী জগদ্ধাত্রী। মূর্তি গড়ে তাঁর পুজো করলেন কৃষ্ণচন্দ্র। রাজবাড়িতে সেই পুজো এখনও হয়। সেইসঙ্গে শহরে আরও পুজোর চল শুরু হয়। এখান থেকেই মায়ের পুজো ছড়িয়ে পড়ে চন্দননগরে। কথিত আছে, মহারাজের কোনও এক দেওয়ানের হাত ধরে পুজো শুরু হয়ছিল সেখানে। প্রথমবার চাউলপট্টিতে পুজো হয়েছিল। সেই দেবী আদি মা হিসেবে এখনও পূজিতা। ধীরে ধীরে চন্দনগরের আরও অনেক বারোয়ারীতে মায়ের পুজো শুরু হয়। এখান থেকেই কলকাতায় জগদ্ধাত্রী পুজোর চল। তখন অবশ্য স্রেফ কয়েকটি অভিজাত বাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজো হত। তালিকায় ছাতুবাবু লাটুবাবুর বাড়ি, চোরবাগান মৈত্রবাড়ি, বটকৃষ্ণ পালের বাড়ি এইসবই ছিল। বর্তমানে তা সংখ্যায় বেড়েছে। বারোয়ারীতেও ঘটা করে জগদ্ধাত্রী পুজো হয়। আকারে বাহারে এতটাই বড় করে হয় যা চন্দননগরকেও টেক্কা দিতে পারে।
বর্তমানে কলকাতার জগদ্ধাত্রী পুজোর কথা বললেই বটকৃষ্ণ পাল বাড়ির নাম সবার আগে আসে। এখানকার পুজো প্রাচীন তো বটেই, সেইসঙ্গে বেশ অন্যরকমও। মাতৃপ্রতিমার সঙ্গে থাকে ভারতের পতাকা। সিংহের শরীরে সাদা তুলো। দেবীর সঙ্গে একাধিক সখী থাকে। রুপোর আসনে দেবী অধিষ্ঠিতা। এখানকার পুজোয় ধুনোপোড়ানোর রেওয়াজ আছে। এবং তা বেশ জনপ্রিয়। তালিকায় এরপরেই রয়েছে চোরবাগান মৈত্র বাড়ির পুজো। এখানেও দেবীর দুই পাশে সখী বর্তমান। শোনা যায়, পুজোর বয়স ২৫০ বছর। তবে এই নিয়ে তর্ক রয়েছে। কারণ চন্দনগরেরও আগে এখানকার পুজো শুরু হয়েছিল, এমনটা বিশ্বাস করতে চান না অনেকেই। ছাতুবাবু লাটুবাবুর বাড়িতেও জগদ্ধাত্রী পুজো হয়। এছাড়া ঠনঠনিয়ার দে বাড়ির পুজো রয়েছে। এই পুজোও শহরের প্রাচীন পুজোগুলোর অন্যতম। এখানেই শেষ নয়, কলকাতায় রয়েছে একাধিক জগদ্ধাত্রী মন্দির। সেখানে বছরভর দেবীর আরাধনা চলে। প্রতিষ্ঠিত মূর্তি রয়েছে গর্ভগৃহে। কোথাও আবার অষ্টধাতুর বা পিতলের মূর্তি। বারোয়ারি পুজোগুলোর মধ্যে জনপ্রিয় উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুরের পুজো। এখানে বাজি প্রদর্শনীও হয় পুজো উপলক্ষে। মূর্তির আকার বেশ বড়। এছাড়া দক্ষিণের দিকে লেক কালীবাড়ির পুজো জনপ্রিয়। আরও অনেক পুজোই হয় শহরের ইতিউতি। সব জায়গায় দুর্গাপুজোর মতো জাঁকজমক হয়তো থাকে না। তবে একেবারে জৌলুসহীন নয় কলকাতার জগদ্ধাত্রী পুজো।