বাঙালি ছট পুজোর দিনক্ষণ নিয়মকানুন না জানুক, ছটপুজো আর ঠেকুয়া তার কাছে সমার্থক। এমনিতেই, বাঙালি সাধারণত খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে কোনও বাছবিচার করে না। বিশেষ করে সব উৎসবের সঙ্গেই তার প্রাণের না হোক, পেটের নিবিড় যোগ। বাঙালির ঠেকে জারি আছে ঠেকুয়া-কিস্সা।
দুর্গা-কালী-জগদ্ধাত্রী পুজোর মাঝেই ছট পুজোর নির্ঘণ্ট। বাংলার নদী-পুকুর, এমনকি খাস কলকাতার রবীন্দ্র সরোবরেও পূজার্থীদের ভিড়। কিন্তু বাঙালির তা নিয়ে আগ্রহ নেই বিশেষ। উলটে যা আছে, তাকে একরকমের নিরাসক্তি বলা যায়। তবে পড়শিদের পুজো নিয়ে নিরাসক্তি থাকলেও সে পুজোর প্রসাদে তার আসক্তি আছে দিব্যি। অর্থাৎ কিনা, ঠেকুয়া।
বাঙালি ছট পুজোর দিনক্ষণ নিয়মকানুন না জানুক, ছটপুজো আর ঠেকুয়া তার কাছে সমার্থক। এমনিতেই, বাঙালি সাধারণত খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে কোনও বাছবিচার করে না। বিশেষ করে সব উৎসবের সঙ্গেই তার প্রাণের না হোক, পেটের নিবিড় যোগ। এ বিষয়ে সে কায়মনোবাক্যে ‘উৎসব যার যার, খাবার সবার’ আদর্শে বিশ্বাসী। তাই পড়শি রাজ্য বিহার, যার বহু মানুষ এ রাজ্যেই পাকাপাকি ঘাঁটি গেড়েছেন বহুদিন, সেই বিহারের দেশীয় উৎসব ছটপুজো এলেই বাঙালি মনও ‘ঠেকুয়া নাম’ জপে। এমনিতে ‘বিহারি’ মানুষদের দেখলে এ রাজ্যের অনেকেই নাক সিঁটকে থাকেন, তবে ছটের আগে অনেকেরই আবার খোঁজ পড়ে, চেনাশোনাদের মধ্যে কোনও বিহারি মুখ দেখা যায় কি না। সে কোনও সহকর্মী হোন কি বাড়ির দুধওয়ালা, যার কাছে ঠেকুয়া আনার আবদার করা যাবে। এখন অবশ্য ইন্টারনেটের যুগ, কেউ কেউ ‘আপনা হাত জগন্নাথ’ মন্ত্র জপে নিজেই বানিয়েও ফেলেন।
বাঙালির পেট বিপুল উদারতায় সব খাবারকেই আপন করে। কিন্তু মন? কার্তিক মাসের শুক্লাপক্ষের ষষ্ঠীতে সূর্যদেবতার পুজোই যে ছট, সেই পুজো নিয়ে অন্যান্য উৎসবের মতো তার জানার আগ্রহ আছে কি? উঁহু। বরং ‘ছট মানেই সেই বিহারিদের ভিড়’- এমন কথা কান পাতলেই শোনা যাবে। পড়শি রাজ্য থেকে বহু রিকশাওয়ালা, ট্যাক্সিওয়ালা, মুটে মজুর শ্রমিক এ রাজ্যের পাকাপাকি ঘরবসত করেছে, বাঙালি তা মেনে নিয়েছে বটে, তবে এই উন্নাসিকতাও তার মজ্জাগতই। নিজের বাঙালি পরিচয় নিয়ে সে কতখানি যত্নশীল বা গর্বিত তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে বিহারিকে ‘খোট্টা’ বলে আত্মশ্লাঘা অনুভব করতে বাঙালি ভালোই বাসে। সেই যে, চন্দ্রবিন্দু কবেই গানে গানে বলে গিয়েছে- “আমরা পাঞ্জাবিদের পাঁইয়া বলি, মাড়োয়ারি মাওড়া/ আর নন-কম্যুনাল দেওয়াল লিখি ক্যালকাটা টু হাওড়া”। বাস্তবিক, মুখে অসাম্প্রদায়িকতার বুলি আওড়ালেও, ভিন সম্প্রদায়কে নিয়ে ঠাট্টা ইয়ার্কি বিদ্রুপ করতে অধিকাংশ বাঙালি এক পায়ে খাড়া। নিজেকে জ্ঞানে বুদ্ধিতে সেরা প্রমাণ করতেও সে অগ্রণী। তবে জ্ঞান বুদ্ধি যে অন্যদের ছোট না করতেই বলে, সে কথা তাকে বলবে কে!
তাই বাঙালি প্রাণপণে হিন্দি শিখবে, আবার পেটপুরে ঠেকুয়াও খাবে, আর তার সঙ্গেই মুখশুদ্ধির মতো জিইয়ে রেখে দেবে ‘বিহারি’ নিয়ে উন্নাসিকতাও।