পাকিস্তান মানেই দেশভাগ, সীমান্ত সমস্যা। রাষ্ট্রনেতাদের ভুরুতে ভাঁজ। সে সব ছাপ এসে পড়ে ছায়া এবং ছবিতে। তবে সম্প্রতি পাক ড্রামায় চোখ রাখছে ভারতীয় তরুণ প্রজন্মও। কীসের টানে? কোন বদল এসেছে কাহিনিতে? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
পাকিস্তান, যে দেশের নামেই রয়েছে ‘পাক’ অর্থাৎ পবিত্রতা। অথচ নানা না-পাক কার্যকলাপের সূত্রে সে-দেশের একটা অন্য ছবিই চোখে ভাসে। মনে পড়ে যায় ২৬/১১, মনে পড়ে যায় আজমল কাসভ। বিশ্বের একমাত্র নিউক্লিয়ার অস্ত্রের অধিকারী, মুসলিম অধ্যুষিত, প্রতিবেশী এই দেশ আমাদের বরাবরই চিন্তার কারণ। সেই মতো বদলায় দুই দেশের কূটনীতি, রাজনীতি এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্কও।
আর কী কী মনে পড়ে পাকিস্তান বললে? পাকিস্তান মানেই দেশভাগ, সীমান্ত সমস্যা। রাষ্ট্রনেতাদের ভুরুতে ভাঁজ। সে সব ছাপ এসে পড়ে ছায়া এবং ছবিতে। অতএব পাকিস্তান মানেই ‘বর্ডার’, পাকিস্তান মানে ‘উরি – দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’, পাকিস্তানের মাটিতে দাঁড়িয়ে হিন্দুস্থানের বদনাম ঠেকাতে টিউবওয়েল উপড়ে ফেলা ‘ঢাঁই-কিলো-কা’ হাত। পাকিস্তান মানে স্ক্রিনে ফুটে ওঠা ‘রিফিউজি’- অপেক্ষায় থেকে যায় নাজ়; আমরা জানি, অভিষেক বচ্চন আর ফেরেন না। পাকিস্তান মানেই বিয়ে করে পাক সেনাপ্রধানের বাড়িতে গুপ্তচর হিসেবে যেতে ‘রাজি’ হয়ে যাওয়া ‘সেহমত’। কিন্তু এসব তো ভারতীয় চোখে পাকিস্তান-দর্শন! বলা ভালো, রাজনীতির লেন্সে পাক-দর্শন। তার বাইরে যে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র সেখানে অবশ্য সীমান্ত-সমস্যা তেমন করে নেই। ফলে পাকিস্তান মানে মেহদি হাসান, সালমা আঘা।
ঘড়ির কাঁটা আর একটু সামনে এগিয়ে আনলে দেখব, ভারতের যেমন শাহরুখ নামের একটা পরিচয়পত্র আছে, পাকিস্তানকে তেমন অনেকেরই চেনা ছিল ফওয়াদ খানের ভুবনভোলানো হাসি, চোখের চাহনি আর রাজপুত্র সুলভ গড়নে। পরবর্তীকালে শাহরুখের নায়িকা হলে, মাহিরা খানের নামে চেনা পাকিস্তানকে। আর এখন, পাকিস্তানি ড্রামা সিরিজের দৌলতে একে একে পরিচয় হচ্ছে, হামজা আলি আব্বাসি, দানিশ তৈমুর, ইমরান আব্বাস,সাবা কামর, হানিয়া আমিরের সঙ্গে। তালিকাটা বেশ দীর্ঘই।
বছর কয়েক আগে পর্যন্তও কে-ড্রামাতে মজে থাকা জেন জ়ি এখন হঠাৎ পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকছে কেন? কে-ড্রামা দেখে অর্থাৎ সেই নিটোল, পুতুল-পুতুল গড়ন আর ধবধবে ত্বকে মন মজে গেল? নাকি ভাষাগত সাদৃশ্য থাকায় পাক ড্রামা বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠল? কিন্তু শুধু ভাষার মিল কি জেন জ়ি দর্শক টানতে সক্ষম? তার জন্য কি জোরদার কনটেন্ট-এর দরকার নেই?
আসুন, জানার চেষ্টা করি কী হচ্ছে পাকিস্তান সিরিজে? হ্যাঁ, সেখানে এক পাকিস্তানি হিরোকে নিয়ে বায়োপিক হয়েছে, রয়েছে এক স্বপ্নের উড়ানের কাহিনিও। সাধারণ স্বাভাবিক দুজন পুরো উলটো ধরনের মানুষের একে অপরের প্রতি আকর্ষণ থেকে নিখাদ বন্ধুত্ব ও প্রেম হওয়ার গল্প নিয়ে হানিয়া আমির এবং ফাওয়াদ মুস্তাফা যেমন রয়েছেন, পাশাপাশি সাবিনা ফারুক এমন একজন নারীর চরিত্রে রয়েছেন যিনি পাকিস্তানের গোঁড়া মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে, তিন তালাকের শাস্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছেন। সাবা কামর তাঁর ড্রামাতে প্রশ্ন তুলছেন সমাজে মেয়েদের অবস্থান নিয়ে, ভালবাসার ভিক্ষা নিয়ে। এই সবের পাশাপাশি যেটা রয়েছে তা হল, পিতৃতন্ত্রের জয়জয়কার। দুঃখিনী, অভাগিনী, কমজোরি নারী, যে কিনা সমাজের বা চারপাশের মানুষের তাচ্ছিল্যে বড় হয়ে উঠছে, তার কাছে হঠাৎ প্রেমিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে কোনও বলবান, আর্থিক সচ্ছল এবং অবশ্যই সুশ্রী ফরসা নায়োকোচিত গড়নের কোনও পুরুষ, এবং সেই নারীটি দুর্বিপাক থেকে ক্রমে উদ্ধার পাচ্ছেন।
তাহলে কী বোঝা গেল? বলিউডি প্রভাব এবং বলিউডি গল্পের সূত্র এবং অনুপ্রেরণা বেশ ভালোভাবেই রয়েছে পাকিস্তানি ড্রামায় শুধু মুখগুলো বদলে বদলে দেখে যাই আমরা। তবে এই সূত্রে যা মনে রাখার তা হল, রাজনৈতিক চাপানউতোর পেরিয়ে সেই সব সিরিজ দেখছে ভারতীয় তরুণ প্রজন্মও। তাতে কি রাতারাতি কিছু বদলে যাবে? তা হয়তো নয়। তবু সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের সীমান্ত খোলামেলা হলে, ঘৃণা-বিদ্বেষের বাড়বাড়ন্তে খানিক লাগাম পড়ে বইকি! তাই বা মন্দ কী!