ভাইফোঁটা বাঙালির অনুষ্ঠান। বাঙালিজীবনের কামনার সঙ্গে তার নিবিড় যোগাযোগ। ব্রতের সঙ্গে তাকে মিলিয়ে দেখলে তাই হয়তো অপরাধ হবে না। সেই সূত্রেই বলা যায়, এই ভাইফোঁটার দুটি ঘটনায় বাঙালি ব্রতকথা যেন পেয়ে গেল আধুনিক সংস্করণ। লৌকিক অনুষ্ঠান লৌকিক জীবনের চাহিদার সঙ্গে আরও একবার সই পাতাল।
ট্রাম কি কেবল বেঁচে থাকবে স্মৃতিতে! ক’দিন আগেই ঘুরপাক খাচ্ছিল এমন প্রশ্ন। শেষমেশ ট্রাম থাকল বটে, ‘যেমন থাকে ভালোবাসার মানুষ অপমানে’। আমরা আর কী করতে পারি? আধুনিকতার নিয়তি বহন করে যাকে চলে যেতে হচ্ছে, বড়জোর তার দীর্ঘায়ু কামনা করতে পারি। ঠিক যেমন ভাইফোঁটার অনুষ্ঠানে ভাইয়ের আয়ু প্রার্থনা করেন বোনেরা। যম অর্থাৎ মৃত্যুর ঘরে কাঁটা দিয়ে সে তো জীবনকেই আগলে রাখার বাসনা। যেমন মানুষকে আগলে রাখে অরণ্য। রোষে প্রকৃতি ফুঁসে উঠলে সকল আঘাত সহ্য করে সে বাঁচিয়ে রাখে মানুষকে। মানুষের সভ্যতায় সেই অরণ্যের অধিকার কি ক্রমে হাতছাড়া হয়ে যাবে! এ প্রশ্ন বহুকাল ধরেই ঘুরপাক খাচ্ছে, যেহেতু মানুষের হাতেই লেখা হচ্ছে অরণ্যহত্যার কিস্সা। অথচ অগণিত মানুষ জানে, প্রকৃতির লালন ছাড়া অসহায়তা বাড়ে বই কমে না। অতএব মানুষ কামনা করে অরণ্যের দীর্ঘায়ু। আয়ু লেখার সেই কাজে হরেক বিঘ্ন। আধুনিকতার দাপট অনেক সময়ই তাকে নিশ্চুপ থাকতে বাধ্য করে। তবু তারই বিপ্রতীপে মানুষের ব্যক্তিগত কিছু অবস্থান থেকেই যায়। যেমন আবহমানের জীবনের গায়ে গায়ে লেগে থাকে ব্রত। মানুষের নিজস্ব অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠান বা ব্রত শুধু কুলুঙ্গিতে তুলে রাখার নয়। মানুষের ভাবনাতেই তা স্পর্শ করতে পারে আধুনিক জীবনের সংকট, সমস্যাকে।
‘ব্রত হচ্ছে মানুষের সাধারণ সম্পত্তি, কোনো ধর্মবিশেষের কিংবা বিশেষ দলের মধ্যে সেটা বদ্ধ নয়’- ‘বাংলার ব্রত’-এর একেবারে গোড়াতেই এ-কথা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই ব্রতের উদ্দেশ্যের কথাও খোলসা করে দিয়ে লিখেছিলেন, “এটাও বেশ বলা যায় যে, ঋতুপরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের যে দশাবিপর্যয় ঘটত সেইগুলোকে ঠেকাবার ইচ্ছা এবং চেষ্টা থেকেই ব্রতক্রিয়ার উৎপত্তি। বিচিত্র অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে মানুষে বিচিত্র কামনা সফল করতে চাচ্ছে, এই হল ব্রত, পুরাণের চেয়ে নিশ্চয়ই পুরোনো বেদের সমসাময়িক কিংবা তাঁরও পূর্বেকার মানুষদের অনুষ্ঠান।” ব্রত তাই স্থির বা অচল নয়। তার মধ্যেই আছে মানুষের জীবনের প্রবহমানতা। বহুযুগের মানুষের যে জীবনধারা, তার দৈব-দুর্বিপাক এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসার চিহ্ন বাঙালির ব্রতকথাই নিহিত। এক অর্থে তা জাতির ইতিহাসই। যে ইতিহাস রাজা-রাজড়ার নয়। মানুষের। মানুষের প্রত্যেকদিনকার বেঁচে থাকার। এবং আজ যে গভীর ইতিহাস বা ডিপ হিস্ট্রির চর্চা চলছে, সেখানেও ব্রতের গুরুত্ব নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে হয়।
অবন ঠাকুরের ভাবনায় যে ‘দশাবিপর্যয়’, সেই শব্দটি লক্ষ্য করার মতো। ঋতুপরিবর্তনের সঙ্গে নানাবিধ দুর্যোগের মুখে পড়তে হয় মানুষকে। এই বিপর্যয় মানুষের জীবনের অবধারিত সত্য। আধুনিক পুঁজিচালিত জীবনযাত্রায় সেই বিপর্যয় আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। তার বহু কারণ আছে। এবং সেই কারণ প্রতিরোধ করার জায়গাটি কতখানি মানুষের হাতে আছে আর নেই, তা তর্কসাপেক্ষ। মানুষের হাতে তবু যা থাকে, তা হল ‘ঠেকাবার ইচ্ছা এবং চেষ্টা’। ভাইফোঁটা বাঙালিজীবনের লৌকিক অনুষ্ঠান। তার সঙ্গে অনেক আখ্যান জুড়ে আছে বইকি! তবু বলা যায়, যে মঙ্গলকামনা ব্রতের আত্মিক চিহ্ন, তা এই অনুষ্ঠানটির মধ্যেও আছে। চলতি ভাইফোঁটার দিনটিতে, ব্রতের মতো করেই ‘বিচিত্র অনুষ্ঠান’-এর মাধ্যমে সেই ‘বিচিত্র কামনা’ সফল করার প্রয়াসটিই আরও একবার চোখে পড়ল।
দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে হয়- এক, ম্যানগ্রোভ অরণ্যে ফোঁটা দিয়েছন সুন্দরবন অঞ্চলের মহিলারা। সাম্প্রতিক ‘ডানা’ ঘূর্ণিঝড়ের স্মৃতি এখনও টাটকা। সেই বিপর্যয়ের হাত থেকে জনজীবনকে রক্ষা করেছে এই ম্যানগ্রোভ অরণ্যই। একই সঙ্গে আলোচনায় উঠে এসেছিল ম্যানগ্রোভ রক্ষার প্রসঙ্গটিও। ম্যানগ্রোভ যদি যথেষ্ট বিস্তারে না থাকে তাহলে ভবিষ্যতের যে কোনও বিপর্যয়ে মানবজাতির অস্তিত্বই প্রশ্নের মুখে পড়বে। ফলে সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষের জীবনচর্যার সঙ্গেই ম্যানগ্রোভ সম্পৃক্ত। অতএব মানুষের স্বার্থেই ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণ জরুরি। এই সম্পৃক্তি ও সখ্যের ভাষ্য যেন ভাইফোঁটাকে আশ্রয় করেই যেন ধরা দিল নতুন আঙ্গিকে। আধুনিকতা, বিশেষত পুঁজিচালিত ব্যবস্থা যে আধুনিকতার ধারনার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটিয়েছে, সেখানে প্রকৃতির সঙ্গে যোগ ক্রমে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছে। সেই বিচ্ছিন্নতা আদতে মানুষকে নিঃস্ব করেছে। এ যেন অয়দিপাউসের নিয়তি! প্রকৃতি থেকে যে মানুষ বিচ্ছিন্ন কোনও সত্তা নয়, এই ভাবনাটিই আজ মানুষের যে কোনও আন্দোলনের মুখ্য কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতীতের ব্রতকথাগুলির দিকে তাকালে দেখা যাবে বানিয়ে তোলা ‘প্রকৃতিপ্রেম’ সেখানে নেই। আছে জল-মাটি-আলো-বাতাস-গাছের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক মহাজীবনের প্রসঙ্গ। আজ তাই যখন ভাইফোঁটা ম্যানগ্রোভকে স্পর্শ করছে, তখন যেন আমাদের শিকড়ই স্পর্শ করছে বর্তমানকে।
এই শিকড় না-হারানোর প্রসঙ্গেই অন্য ঘটনাটি তাৎপর্যপূর্ণ। ট্রামের দীর্ঘায়ু কামনা করেও ফোঁটার আয়োজন করেছেন মহিলারা। ট্রাম কলকাতার অমোঘ পরিচয়পত্র। আজ তা অবলুপ্তির পথে। একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পরিবর্তে কোনক্রমে টিকে আছে। ট্রাম উঠে গেলে কলকাতা যে তার বিশিষ্টিতা হারাবে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। তবু সময়ের মার বলে অনেকেই এই পরিণতি মেনে নিচ্ছেন। এই যখন পরিস্থিতি, তখন ট্রামের অবলুপ্তির দুয়ারে কাঁটা দিয়ে সেটির কপালে ফোঁটা দিলেন মহিলারা। এ যেন এক অন্য ‘অযান্ত্রিক’। ভাইফোঁটার অনুষ্ঠানের ভিতর ঢুকে পড়ে ট্রাম জীবন্ত এক চরিত্রই হয়ে উঠেছে। আদতে এই কলকাতার প্রাণের অনুসন্ধান করতে গেলে ট্রাম জীবন্তই বটে! বাঙালির লৌকিক অনুষ্ঠান যখন তাকে টেনে নিল আখ্যানের অন্দরে, তখন ট্রাম হয়ে উঠল এ শহরের নাগরিক। তবু তর্কের খাতিরে প্রশ্ন উঠতে পারে, ফোঁটা দিয়ে কি ট্রামের বিলুপ্তি রোধ করা যাবে! এখানেই আবার আসে ব্রতের প্রসঙ্গ। অবন ঠাকুরের কথায় বিপর্যয় ‘ঠেকাবার ইচ্ছা’ ব্রতের মৌলিক চিহ্ন। ট্রাম যাতে হারিয়ে না যাওয়া সেই কামনা সফল করা জন্যই তো এই অনুষ্ঠান।
ভাইফোঁটা বাঙালির অনুষ্ঠান। বাঙালিজীবনের কামনার সঙ্গে তার নিবিড় যোগাযোগ। ব্রতের সঙ্গে তাকে মিলিয়ে দেখলে তাই হয়তো অপরাধ হবে না। সেই সূত্রেই বলা যায়, এই ভাইফোঁটার দুটি ঘটনায় বাঙালি ব্রতকথা যেন পেয়ে গেল আধুনিক সংস্করণ। লৌকিক অনুষ্ঠান লৌকিক জীবনের চাহিদার সঙ্গে আরও একবার সই পাতাল। যদি এহেন ব্রতকথার পরিসর প্রসারিত হয়, তবে সচেতনতার ক্ষেত্রটি আরও বিস্তৃত হবে। ব্যক্তি ভাই-বোন নয়, বাঙালির সামগ্রিক সামূহিক জীবনেরই মঙ্গলকামনা সেখানে।