ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা, শচীন-সৌরভে যে যেমন পারে খানখান; শুধু বিবিধের মাঝে মিলন বলতে ওই একজনই– শাহরুখ খান। সাদা-কালো স্ক্রিনে ভেসে আসা দূর সমুদ্রের এক রঙিন নাবিক। এমনকি যখন কথা বলা কঠিন হয়ে এল; যখন ধর্মে-কর্মে জোর ঠোকাঠুকি লেগে গেল; তখনও থেকে গেলেন তিনি। অবশ্য সময়ের কাচ বিঁধেছে শাহরুখেও। ‘লাভ’ আর ‘লাভ জিহাদের’ দেশ তো এক নয়। এই দেশে শাহরুখ নিশানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা মুশকিলই বটে। তবুও, যে ফুসমন্তর মিলিয়ে যায় না, মিলিয়ে দেয়, শাহরুখ তারই নাম।
অ্যান্টেনা কোনোদিন বুঝতেই পারেনি যে, শাহরুখ খানকে ঝাপসা করা যায় না।
অপূর্ব এক নাশকতায় সে একটু-না-একটু নড়ে যাবেই। আর তত কেঁপে কেঁপে উঠবেন শাহরুখ। আমরা ভালো বুঝতে পারতাম না, দোর্দণ্ডপ্রতাপ অমরীশ পুরীর সামনে এসে স্বয়ং শাহরুখ বেশি কাঁপছেন নাকি অ্যান্টেনা তাঁকে কাঁপাচ্ছে! এই আমরা কারা? না, ফ্যান ক্লাব বস্তুটির আভাস তখনও সেভাবে ছিল না। পাড়ায় পাড়ায় ইস্যুভিত্তিক জোট। দু-চার আনা তর্ক। খুচরো ঝগড়া পকেটে পুরে সাইকেলের ঝপাঝপ রাগত প্যাডেল। কমেন্টের গোঁসাঘর সেইসব দিনে স্ক্রিনশট হয়ে জমে থাকত না। চালান হত না গোপন রাগের কালচে ছোপ। মামলা মিটে যেত দু-একটা মামলেটে। ফলত ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা, শচীন-সৌরভে যে যেমন পারে খানখান; শুধু বিবিধের মাঝে মিলন বলতে ওই একজনই– শাহরুখ খান। সাদা-কালো স্ক্রিনে ভেসে আসা দূর সমুদ্রের এক রঙিন নাবিক। ভিসিআর আর সিডি চাকতির খেলায় সে এক নতুন বাজিগর। বেচারি অ্যান্টেনা! ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি এক বাক্স বোকা আক্ষেপ বুকে নিয়ে তাকে একদিন মিলিয়ে যেতে হবে। ডিস এসেও হিসহিসে সময়ের বিষদাঁত থেকে রেহাই পাবে না। যাকে যাওয়ার তাকে চলে যেতেই হয়। শুধু থেকে যান, সেই সেদিনের কেঁপে ওঠা নায়ক শাহরুখ খান। থাকেন, যাকে বলে, একেবারে কাঁপিয়ে। এক দশক, দু-দশক, তিন দশক…। কেটে যায়। শাহরুখ যেন পরিবারের সেই পুরনো হাতঘড়ি। কবজি বদলালেও যাকে কেউ কবজা করতে পারে না। বুড়ো কাঁটা ঠিক সময় ঘুরিয়ে দেয়।
মানুষটার উপর কি রাগ হয় না? হয় বইকি! এক টাকার স্টিকারে শাহরুখের ছবি যারা বইয়ের পিছনের মলাটে সেঁটে দিয়েছিল তাদের আই ড্রাই হয়ে এখন জ্বালা করে। শাহরুখের জুলপি তবু সাদা হয় না। নিরেট সময়ের ভিতর ভালোবাসার সিঁদ হাতে আশ্চর্য সব সুড়ঙ্গ রচনা করেন তিনি। আর কোনও এক গ্রিটিংস কার্ডের লুকনো লাভ সাইন থেকে তিনি চালান হয়ে যান হোয়াটসঅ্যাপের স্টিকার ইমোজিতে। এই কি কথা ছিল? সেই অন্ধকার হল তো সেদিন এমন কথা শোনায়নি। পঁচানব্বইয়ের অক্টোবরে সেইসব আঁধারে যে আলো জ্বলে উঠল, তার ডাক নাম মনের মানুষ।
না, শাহরুখ নিজে নিজেকে চেনাতে পারেননি। চেনালেন কাজল। বোঝালেন, জীবনে সেই একজন মানুষ দরকার, যারে হাত ধরে জয় মা বলে ভাসাও তরী! কিন্তু বাবুজি কী বলবে! ছুটকি যদি জেগে যায়! যায় তো যাবে! শাহরুখ ছাদের পাঁচিল ডিঙিয়ে ঠিক আসবেনই। হলভরা অন্ধকার বিস্ময়ে দেখল, এ কোন নায়ক, যে বাড়ির মহিলাদের সঙ্গে বসে গাজরের খোসা ছাড়াচ্ছে, লস্যির গ্লাস হাতে দৌড়ে মরছে, এমনকি বুয়াজির জন্য শাড়িও বেছে দিচ্ছে। এমন আবার হয় নাকি! এসব তো ‘মেয়েলি’ কাজ। যদি কোনও ছেলে এমন করতে ভালোও বাসে, বাড়ির পুরুষরাই তাকে বুঝিয়ে দেন, ঘরে-বাইরের ফারাক। পুরুষ অর্থ উপার্জন করে। মহিলাদের সবই ‘লেবার অফ লাভ’। তবে ‘লাভ’কে কি আর এত সহজে লোকসানের খাতায় ফেলে দেওয়া যায়! ভালোবাসা অর্জন করা সহজ নয়। মহিলাদের অনেক কিছুর বিনিময়েই সে ভালোবাসা উপার্জন করতে হয়। পুরুষদের পৃথিবী তার থেকে একটু দূরের পাওয়ার স্টেশন। তাদের মাধুকরী নেই, দেনাপাওনা নেই; যেন সকলই প্রাপ্য। আর তার মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন রোগাসোগা একজন যুবক। যাকে ভালোবাসা অর্জন করতে হয়। পরিবার থেকে বিচ্যুতি সে চাইছে না। আবার বেছে নিচ্ছে না কোনও এসকেপ রুটও। অতএব শেষ দৃশ্যে রক্তাক্ত হয়ে সে যখন ট্রেন থেকে হাত বাড়ায়, এক হল মানুষ শ্বাসরোধ করে প্রার্থনা করে, হে ঈশ্বর, এবার যেন গোঁড়ামির হাত থেকে মুক্তি পায় মেয়েটি। শেষমেশ সেই মুহূর্তটুকু বাস্তব হয়ে উঠলে সকলেই একবাক্যে বলে, ওদের ভালো হোক। ছেলেটি সেদিনই চলে গেল পর্দার ওপারে। আর হলে যারা ছিল, যারা থাকবে ভবিষ্যতে, সকলের কানে কানে বলে বেড়াতে লাগল, ভালোবাসা অর্জন করে নিতে হয়। দেখা মেলে মনের মানুষের।
অতএব এবার পাড়ায় পাড়ায় শাহরুখ। সেলুনের আয়নামহল বচ্চন, মিঠুন, সঞ্জয় দত্তের এতদিনকার সাম্রাজ্য। ছেলেটির জায়গা হল সেখানেও। চুলের ছাঁটে এখন থেকে ‘খান’দানি। বাই-সাইকেলের গার্ডে রাবারের কভারে; মহব্বতে সোয়েটারে; লাভ সাইন বেলুনে, বইয়ের ফাঁকে তুলে রাখা পোস্টকার্ড সাইজের ছবিতে; গানের জমিয়ে রাখা ক্যাসেটে তেরা জাদু চল গ্যায়া ও জাদুকর! কেউ বা বুঝল। কেউ বুঝল না। শাহরুখ খান নামের এক আসক্তি ততদিনে পেয়ে বসেছে সব্বাইকে। খাঁটি বচ্চনভক্তরা অবশ্য তখনও সেভাবে মানতে পারেন না। মিঠুনগোষ্ঠী তাকায় ঠারেঠোরে। সঞ্জয়-মাধুরীর দল পাত্তাই দেয় না। গোবিন্দা-করিশ্মায় মুগ্ধ নাচের আসর আড়চোখে কটাক্ষ হানে। হলে কী হবে! সেই করিশ্মা, মাধুরীরই তো তখন ‘দিল তো পাগল হ্যায়’! অতএব কিছুই আর করার নেই। বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সাক্ষাৎকার ততদিনে জানিয়ে দিয়েছে, শাহরুখ এক এবং একক। নিজের চেষ্টায় গড়ছেন তাঁর রাজত্ব। তাঁর আগের বহু নায়কের ক্ষেত্রেও তো তা-ই ছিল। দেবানন্দ, দিলীপকুমার কারোরই তো গডফাদার ছিল না। নয়ের দশকের একেবারে গোড়ায় অবশ্য ফিল্মি বাড়ির ছেলেদের আনাগোনা বাড়ছিল। আর ঠিক সেখানেই মধ্যবিত্ত বাড়ির একটি ছেলের ‘কিং’ হয়ে ওঠা। সেলফ্-মেড। ঠিক সিনেমার মতোই। স্বপ্নের নায়ক। তবু তাঁর কোনও স্ক্যান্ডাল নেই। সহ-নায়িকাদের তিনি বলেন সহযাত্রী, কমরেড। সিনেমাপাড়ার ভাঙা সংসার, বহু বিয়ে, বহুগামিতার উলটোদিকে সে যেন একেবারে অন্য এক মহাকাব্যের ভূমিকা। বদলে যাওয়া দিনকালে তখন নানারকমেরই স্বাধীনতা মিলছে। পরিবার ভাঙছে। অথচ কোথাও যেন একটা পুরনো সেই দিনের সুতো হাতে বেঁধে রাখতে মন চাইছে। সেই চাওয়াটুকু হয়ে উঠলেন শাহরুখ। বহু কাঙ্ক্ষিত এক সেতু। মোবাইল বিপ্লবের বহু আগে শাহরুখই সেই অমোঘ ‘নেটওয়ার্ক’ যা ভেঙে যাওয়ার দিনেও একসঙ্গে জুড়ে রাখতে পারে অনেককে।
তবু শুধু কি রোমান্সে ঢালিয়া দেব মন? প্রমোদের মদে নেশা আর কতদিন টেকে! বয়স বাড়ে। সংসারে চাপ বাড়ে। বাজারে জিনিসের দাম বাড়ে। রাজনীতিতে দল বাড়ে। পাড়ায় পাড়ায় ঝামেলা বাড়ে। শাহরুখ খান পার্টিতে থাকেন, পলিটিক্সে নেই। তবে কি তিনি কেয়াপাতার নৌকার নাবিক! নাকি তলে তলে তিনি অন্য কথাও কিছু বলছেন! ‘দিল সে’, ‘ইয়েস বস’ হয়ে ‘স্বদেশ’, ‘চাক দে ইন্ডিয়া’, ‘মাই নেম ইজ খান’। সময়ের রং বদলে, বদলে বদলে যান শাহরুখ খান। শুধু তাঁর ভালোবাসার জোরটি মরতে মরতেও মরে না।
এমনকি যখন কথা বলা কঠিন হয়ে এল; যখন ধর্মে-কর্মে জোর ঠোকাঠুকি লেগে গেল; তখনও থেকে গেলেন তিনি। অবশ্য সময়ের কাচ বিঁধেছে শাহরুখেও। ‘লাভ’ আর ‘লাভ জিহাদের’ দেশ তো এক নয়। এই দেশে শাহরুখ নিশানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা মুশকিলই বটে। সে তিনি যতই পর্দার ‘ডন’ হোন না কেন! সিঙ্গল স্ক্রিনের সেই উন্মাদনা যেন আর নেই। অন্ধকার হলঘরে নক্ষত্রজন্মের আশ্চর্য মুহূর্তদের গিলে ফেলছে কফি আর পপকর্ন। সংকটে আর বয়কটে সিনেমার নাভিশ্বাস! শাহরুখ অতএব সত্যিই কিছুদিন গেলেন মিলিয়ে।
তারপর একদিন দৈবাৎ অবসর মিলে যায়। পুরনো ডায়রি ঘাঁটতে ঘাঁটতে বেরিয়ে আসে দু-চারটে অতীত দিনের ফুরিয়ে যাওয়া লজেন্সের রঙচঙে রাংতা। আর ঝপ্ করে খসে পড়ে সেই লুকোনো গ্রিটিংস কার্ড। জেল পেনে লেখা শাহরুখের নামে আজও যেন ধুলো পড়েনি। জানলা দিয়ে বাইরে চোখ রাখলে দেখা যায়, শাহরুখ আসলে মিলিয়ে যাননি। তিনি মিলিয়ে দিতে এসেছেন। হিট-ফ্লপের গল্পগুলো। জীবনে হওয়া আর না-হওয়াগুলো। মেলা আর না-মেলা অঙ্কগুলো। পুরনো একটা দিন হঠাৎ বেঁচে উঠে যেন বুঝতে পারে, সবকিছু এলোমেলো হওয়া দিনকালেও কে একজন এসে দাঁড়ায় দু-বাহু মেলে। ভাঙা-ভাঙা মন, ভাঙা-ভাঙা স্বপ্নেরা আবার একজোট হয়। শ্বাস নেয় প্রাণভরে। আর সেই কয়েক দশক আগের দেওয়ালে টিকটিক করে শব্দ হয় তখন। কে যেন বলে, সত্যের টিকটিকি। শাহরুখ খান ঝাপসা হয় না। তাকে ম্যাজিক বললে ম্যাজিক! যুক্তি বললে যুক্তি। তক্কো কিংবা গপ্পো।
আজও সেই একইরকম, কুছ কুছ হোতা হ্যায়, তুম নেহি সমঝেগা, বোকা অ্যান্টেনা!