ধন নয়, ধানের কামনা। তাই লক্ষ্মীর আবাহন ছিল বাংলার ঘরে ঘরে। সেই শস্যলক্ষ্মীর পুজোরীতিটি ধরে রেখেছে দীপান্বিতা তিথি। শাস্ত্রের তিথি নক্ষত্রের সঙ্গেই সমান্তরালে বয়ে চলেছে বাঙালির নিজস্ব প্রথা।
‘এসো মা লক্ষ্মী বোসো ঘরে’- নিজের ভাষায়, নিজের মনে এমন করেই লক্ষ্মী দেবীকে ডেকেছে বাঙালি। সে ডাকে শাস্ত্রের, নিয়মের যোগ যতখানি, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রাণের যোগ। আসলে পুরনো দিনের বাংলায় সম্পদের উৎস বলতে ধান। তথা শস্য। সেই শস্য থেকেই মিলবে ধন। তাহলে, যে দেবীর বরে সম্পদ মিলবে, তাঁকে তো ভক্তেরা বারেবারে ডাক পাঠাবেই। ধুমধাম করে, আড়ম্বরে আবাহন নয়; ঘরের কোণে আঁচল জড়ানো বধূটি সইয়ের মতো তাঁকেই বলবে সংসারের সচ্ছলতার কথা। সেই আপন করা আবাহনই বাংলায় লক্ষ্মীপুজোর নিজস্ব রীতি হয়ে বয়ে চলেছে। তাই কেবল দুর্গাপূজার সঙ্গে জুড়ে থাকা লক্ষ্মীপুজো নয়, দীপান্বিতা কালীপুজোর দিনও লক্ষ্মী দেবীর জন্য আসন পাতে বাংলার ঘর।
নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ বইয়ে লিখেছেন, “আমাদের লোকধর্মে লক্ষ্মীর আর একটি পরিচয় আমরা জানি এবং তাঁহার পূজা বাঙালি সমাজে নারীদের মধ্যে বহুল প্রচলিত। এই লক্ষ্মী কৃষি সমাজের মানস-কল্পনার সৃষ্টি, শস্য-প্রাচুর্যের এবং সমৃদ্ধির তিনি দেবী।” লক্ষ্মীপূজার আলপনা এবং উপকরণে ধানের শিষ, ধানের ছড়া, কলাগাছ, হরীতকী- এ সবকিছুর মধ্যে রয়েছে শস্যের রূপক। লক্ষ্মী দেবী যে শস্যের দেবী, ‘বাংলার ব্রত’ বইয়ে এ কথার প্রমাণ দিয়েছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। তিনি জানিয়েছেন, বাংলায় মূলত তিনটি লক্ষ্মীব্রত পালন করেন মেয়েরা। নজর করলে দেখা যায়, তিনটি পুজোর সময়কালই সাযুজ্য রেখেছে কৃষিকাজের সঙ্গে। ফাল্গুন মাসে বীজ বপনের আগে যে লক্ষ্মী পুজো পান, তিনি হরিতা দেবী, অর্থাৎ গাত্রবর্ণ সবুজ। তাঁর আরাধনা করে তবে ঘর থেকে বীজ বের করে মাঠে নিয়ে যাওয়া হয় বোনার জন্য। দ্বিতীয় লক্ষ্মীব্রত হয় আশ্বিনের কোজাগর পূর্ণিমায়, যখন মাঠে মাঠে দেখা দিয়েছে নতুন ফসল। এই লক্ষ্মী তাই হলুদ বরন, স্বর্ণলক্ষ্মী। আর তৃতীয় লক্ষ্মীব্রতটি হয় অঘ্রানে, যখন পাকা ধান ঘরে এসেছে। ইনি হলেন অরুণা লক্ষ্মী। আর দীপান্বিতার দিনেও বাংলার ঘরে হয় লক্ষ্মীপুজোর আরেক অনুষ্ঠান, যাকে বলা হয় অলক্ষ্মী বিদায়।
পুরাণে বলা হয়েছে, সমুদ্র মন্থনের ফলে হাতে অমৃতের পাত্র নিয়ে পাতাল থেকে উঠে আসেন দেবী লক্ষ্মী। তবে অমৃতের সঙ্গে যেমন উঠে এসেছিল গরল, লক্ষ্মীর সঙ্গেই উঠে এসেছিলেন অ-লক্ষ্মী। পুরাণ ও শাস্ত্রে দেবী অলক্ষ্মীকে বর্ণনা করা হয়েছে কুরূপা, ঈর্ষা ও দুর্ভাগ্যের প্রতীক হিসেবেই। বলা হয়, লক্ষ্মীর পিছু নিয়ে গাধার পিঠে চেপে তিনিও হাজির হন গৃহস্থের ঘরে। কিন্তু লক্ষ্মীকে ঘরে রাখার জন্য অলক্ষ্মীকে যে বিদায় দিতে হবে। তাই কালীপুজোর দিনেই গোবর দিয়ে অলক্ষ্মীর পুতুল বানিয়ে দরজার বাইরে ফেলে আসা হয়। তারপর দেবী লক্ষ্মীর মূর্তিকে ভক্তিভরে অর্চনা করা হয়। কিন্তু বাংলার নিজস্ব ঘরোয়া ব্রত-অর্চনার কথা বলতে গিয়ে অবনীন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন, “এই অলক্ষ্মীই হলেন অন্যব্রতদের লক্ষ্মী বা শস্যদেবতা। শাস্ত্র নিজেদের মা-লক্ষ্মীকে এই প্ৰাচীন লক্ষ্মীর স্থানে বসিয়ে অলক্ষ্মী নাম দিয়ে কুরূপী-কুৎসিতা বলে একে ছেঁড়া চুল ও ঘরের আবর্জনার সঙ্গে বিদায় দিতে চাইলেন। মেয়েরাও ব্ৰহ্মকোপের ভয়ে অলক্ষ্মীর পুজোর জায়গা বাইরেই করলেন; এবং যথাবিধি পুজা করা না-করার দায়-দোষ সমস্তই পূজারিরই নিতে হল”।
তবে শাস্ত্র যেমন অলক্ষ্মীকে অশুভের সঙ্গে জড়িয়ে অসম্মানে ঠেলে দিল, বাঙালির সকলকে-আপন-করা স্বভাব কিন্তু তা করতে পারেনি। মেয়েরাও যেমন পূজারির কথা শুনে অলক্ষ্মীকে বেশি অপমান করতে ইতস্তত করলেন, তেমনই একসময় যাঁকে লক্ষ্মী বলা হত তাঁর সম্মান খানিক রাখলেন পূজারি নিজেও। ঘরের বাইরে হলেও মা-লক্ষ্মীর আগে অলক্ষ্মীর পুজো হবে, এমনটাই তাই বাংলার রীতি। লক্ষ্মীপুজোর সঙ্গে কলার পেটোর উপরে তিনটি পিটুলির পুতুল সবুজ হলুদ লাল তিন রঙে প্ৰস্তুত করে রাখা হয়। এই তিন পুতুলকে বলা হয়- লক্ষ্মী, নারায়ণ আর কুবের। এই পুতুলগুলিও অনাৰ্য লক্ষ্মীপূজার নিদর্শন। তবে সবুজ, হলুদ ও লাল, এই তিন রং মিলে যাচ্ছে বাংলার সেই তিন ধরনের লক্ষ্মীর বর্ণের সঙ্গেও। যা থেকে বোঝা যায়, ধনদেবীর বিপুল রমরমায় বাংলার নিজস্ব লক্ষ্মী দেবীকে জায়গা ছেড়ে দিতে হয়েছে বটে। তবে যে রীতি তৈরি হয়েছিল প্রাণের তাগিদে, বাঙালির সেই লক্ষ্মী আরাধনার রীতি কিন্তু আড়ালে আবডালে বয়েই চলেছে আজও।