একের পর এক ধর্ষণ খুনের ঘটনা। দেখা যাচ্ছে, প্রায় সবসময়েই ধৃতদের সঙ্গে পর্ন আসক্তির গভীর যোগ। দেশে পর্ন আসক্তি যেভাবে বাড়ছে, তার সঙ্গে কি তাহলে কোনও যোগ রয়ে যাচ্ছে অপরাধের বাড়বাড়ন্তেরও? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
আর জি কর কাণ্ডে যখন রাজ্য তো বটেই, সারা দেশেই প্রতিবাদ শোনা যাচ্ছিল, সেই সময়েই সামনে আসে আরও এক খবর। জানা যায়, সেই ধর্ষিতা চিকিৎসক তরুণীকেই পর্ন সাইটে খুঁজে বেড়াচ্ছে বহু লোক। শুধু তাই নয়, সম্প্রতিই আর জি কর কাণ্ডে ধর্ষণে অভিযুক্ত বলে যাকে গ্রেপ্তার করা হয়, তার সঙ্গেও পর্ন আসক্তির গভীর যোগ খুঁজে পান তদন্তকারীরা। দেখা যায়, পর্ন ভিডিও, বিশেষ করে বিকৃত পর্ন ভিডিও দেখার নেশা রয়েছে তার। ধর্ষিতাকে পর্ন সাইটে খোঁজার এহেন ঘটনা ঘটেছে কাঠুয়ার সেই আট বছরের ধর্ষিতা বালিকা আসিফার ক্ষেত্রেও। এর আগেও শোনা গিয়েছে, জ্যোতি, প্রিয়াঙ্কা, একের পর এক নাম জুড়েছে ধর্ষণের তালিকায়, আর ততই নতুন নতুন আকর্ষণ যোগ হয়েছে এক শ্রেণির পর্ন-দর্শকের সার্চ লিস্টে। যেখানে প্রবল যন্ত্রণা সয়ে মরে যাওয়া মেয়েও নিছক ভোগ্য। নেহাতই পণ্য। অনেক মানুষের কাছে সে তখনও বিনোদন। সংবেদনকে একেবারে ধুয়েমুছে দেওয়া এই অন্ধ প্রবৃত্তিই অপরাধের পটভূমি হয়ে উঠতে পারে, এ কথা তো অস্বীকারের জো নেই। কেন-না যে মানুষ সংবেদনহীন, সহানুভূতি-মমতার লেশমাত্র যার মধ্যে নেই, সে-ই অপরকে সহজে আঘাত করতে পারে। নৃশংসভাবে অত্যাচার করতে পারে। ফলত, পর্ন সাইটের তথ্য থেকে এই যে বিপুল পরিমাণে অসংবেদনের ছবিটা উঠে আসছে, তাতে বিশেষজ্ঞদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়তে বাধ্য। অনেকেই মনে করেন, পর্নের প্রতি অত্যধিক আসক্তি আসলে যৌনতাকে বিকৃতভাবে দেখতে শেখায়, যেখান থেকে মানুষের মনে বিকৃত অবদমিত আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে। চিন্তা এখানেই যে, দেশে পর্ন আসক্তি যেভাবে বাড়ছে, তার সঙ্গে কি তাহলে কোনও যোগ রয়ে যাচ্ছে অপরাধের বাড়বাড়ন্তেরও?
এমনিতে অতিমারির কারণে ঘরবন্দি থাকার ফলে বেড়েছে নেটমাধ্যম বা অনলাইনে সময় কাটানোর প্রবণতা। তারই হাত ধরে উঠে এসেছে পর্নোগ্রাফির প্রতি আসক্তিও। পর্ন দেখার প্রবণতায় বিশ্বের বাকি সব দেশকে পিছনে ফেলে দিয়েছে কামসূত্রের ভারত। একটি প্রাপ্তবয়স্ক সাইটের তথ্য থেকে জানা গিয়েছিল, ২০১৯ সালেই মোবাইল ডিভাইস থেকে পর্ন ছবি দেখেছেন ৮৯ শতাংশ ভারতীয় স্মার্টফোন ব্যবহারকারী। পরবর্তী লক ডাউন কালে সে সংখ্যাটা আরও বাড়লে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
কিন্তু অবাক হতে হয় তার পরবর্তী সময়ে যৌন অপরাধের প্রবণতাগুলির দিকে তাকালে। সাড়া জাগানো ধর্ষণের ঘটনাগুলি যদি ছেড়েও দিই, কয়েকটি ঘটনা নজরে পড়ার মতো। ২০২২ সালে একটি ১৪ বছরের কিশোর ১০ বছরের এক পড়শি বালককে যৌন হেনস্তার অপরাধে অভিযুক্ত হয়। ২০২৩ সালে সামনে আসে এক ডেলিভারি বয়ের কথা। বছর ২৭-এর তরুণ মহিলা ক্রেতাদের ফোন নম্বর সেভ করে তাঁদের পর্ন ভিডিও পাঠাত। সম্প্রতিই মুম্বাই-এর এক ১৩ বছরের কিশোর নিজের বছর ১৫ বয়সের দিদিকে ধর্ষণ করে বলে জানা গিয়েছে। সেসময় দুজনেই একসঙ্গে পর্ন দেখছিল বলে জানা যায়। অর্থাৎ এই প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেই পর্ন দেখার কথা সামনে আসছে। ভারতে সুলভ নেট এবং সেই সুযোগে সহজে পর্ন ভিডিও দেখার সুযোগ এই জাতীয় অপরাধের প্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে বলেই আশঙ্কা করছেন মনস্তত্ত্ববিদেরা। পর্ন ভিডিওর যান্ত্রিক যৌনতায় ভালোবাসা এবং সেই সূত্রে আসা যৌনতাকে চিনে উঠতেই পারছে না দেশবাসীর একটা বড় অংশ। বদলে বিকৃত যৌনতা, জোর খাটানো বা নির্যাতনকে স্বাভাবিক বলে মনে করছে অনেকেই। আর সেই মানসিক প্রবণতা দেশে যৌন অপরাধের হার বাড়াচ্ছে বলেই মত বিশেষজ্ঞদের একাংশের। কিন্তু আইনি পথেও পর্নসাইটগুলি যেহেতু পুরোপুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না, ফলে এর থেকে সমাধানের উপায় কী হতে পারে, সে পথও দেখা যাচ্ছে না আপাতত।