কালো বা নীল নয়। কালীর গায়ের রং সাদা। পদতলে সেই মহাদেব। অন্যান্য বৈশিষ্ট্যও প্রায় এক। শুধু গায়ের রং আলাদা। এও নয়, বাংলায় এমন কালী মূর্তি রয়েছে একাধিক। নিত্য পূজিতা হন দেবী শ্বেতকালী। মন্দির রয়েছে কোন কোন জায়গায়? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
শয়নরত মহেশ্বরের বুকের উপর পা দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন চতুর্ভূজা দেবী। ঘোর কৃষ্ণবর্ণ এই দেবীমূর্তি লোলজিহ্বা। ইনিই দেবী কালী। দেবীর এই প্রচলিত মূর্তিই দেশের নানা প্রান্তে পূজিতা। দীপান্বিতা অমাবস্যার দিনে মণ্ডপে মণ্ডপে কালী আরাধনার ব্যবস্থা হয়। সেক্ষেত্রে অবশ্য শাম্যাকালী অর্থাৎ নীল বর্ণের কালী নজরে আসে। কিন্তু কালীর রং ধবধবে সাদা, এমনটাও হতে পারে?
শুনতে অবাক লাগলেও বাংলায় শ্বেতকালী পুজোর চল রয়েছে। মূর্তি খানিক আলাদা। তবে তন্ত্রের দেবী। পুজো হয় শাক্তমতে। কোথাও কোথাও বলির চলও রয়েছে। ভোগ হিসেবে দেওয়া হয় আমিষ পদ। কালী পুজোর সঙ্গে তেমন পার্থক্যও নেই।। স্রেফ দেবীর গায়ের রং আলাদা। একেবারে সরস্বতীর মতো, ধবধবে সাদা। বাংলার শ্বেতকালীর তালিকায় প্রথমেই রয়েছেন হুগলীর রাজবলহাটের মা রাজবল্লভী। দেবী দ্বিভুজা। এক হাতে ছুরি, অন্যহাতে রুধির পাত্র। পদতলে কালভৈরভ। দেবীর এক পা শিবের এই রূপের বুকে। অন্য পা আরেক রূপ তথা বিরূপাক্ষের উপর। দেবী ত্রিনয়না। ডাগর চোখ, স্মিত হাসি। অনেকটা মা দুর্গার মতো। দেবীকে মাছের ভোগ দেওয়া হয়। এছাড়া প্রতিদিন দেবীর শাড়ি বদল হয়।
ভক্তরাই পুজো হিসেবে শাড়ি দিয়ে যান মন্দিরে। তবে কালীর মতো এই দেবীর গলাতেও মুণ্ডমালা রয়েছে। কোমরবন্ধনীতেও কাটা হাত। কালী পুজোর সময় এই মন্দিরেও বিশেষ পুজোর ব্যবস্থা করা হয়। দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা আসেন পুজো দিতে। দেবী রাজবল্লভীর আরও কিছু মন্দির রয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। এছাড়া কালী পুজোর সময় কলকাতার চেতলার এক ক্লাব রাজবল্লভী মাতার আরাধনা করে।
এরপরই বলতে হয় হুগলির আরও এক শ্বেতকালীর কথা। আঁটপুরের দেবী সিদ্ধেশ্বরী। স্থানীয়দের কাছে এই দেবী রাজবল্লভী মাতার বোন। মূর্তি অবশ্য একেবারেই আলাদা। সাধারণ কালী মূর্তির মতোই এই দেবীর রূপ। চতুর্ভুজা দেবীর একহাতে খড়গ, একহাতে নরমুণ্ড, অন্য দুই হাতে বরাভয়। পদতলে শায়িত মহাদেব। দেবীর পাশে রয়েছে শিয়াল। এখানেও আমিষ ভোগ দেওয়ার চল রয়েছে। আবার কুলটির লালবাজারে ফলহারিণী কালীর রংও সাদা। এই বিগ্রহেও পার্থক্য বলতে স্রেফ দেবীর গাত্রবর্ণে। বাকি সব এক। মূর্তিটি আনা হয়েছিল বাঁকুড়ার শুশুনিয়া থেকে। দেবীর নিত্য পূজার ব্যবস্থা রয়েছে। সেবায়েতের দাবি মায়ের এই রূপ তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন। সেইমতো মূর্তি তৈরি করেন। তবে ওই অঞ্চলে আর কোথাও সাদা কালীর মূর্তি নেই।
পরবর্তী শ্বেতকালীর দেখা মেলে বীরভূমে। তারাপীঠের অদূরে অজয়পুর গ্রাম। সেখানেই দেখা মেলে সাদা রঙের কালীর। তবে এই কালীও খানিক আলাদা। অনেকটা তারা মায়ের মতোই রূপ। আবক্ষ মূর্তি। ডাকের সাজে অপরূপ শোভা দেবীমায়ের। মূর্তির মতো পুজোর দিনও এখানে আলাদা। অমাবস্যার বদলে ভরা পূর্ণিমায় দেবীর পুজো হয়। চাঁদের আলোয় কালীপুজো আর কোথাও সম্ভবত হয় না।
এই মূর্তির অনুরুপ বিগ্রহ দেখা যায় সেই চেতলাতেই। কালী পুজোর সময় সেখানকার এক ক্লাব ঘটা করে শ্বেত তারা পুজোর ব্যবস্থা করে। অজয়পুরের দেবীর সঙ্গে এই বিগ্রহের বেশ মিল রয়েছে। মোটের উপর বাংলার এই কয়টিই শ্বেতকালী পুজোর চল রয়েছে। প্রতিটি পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস। যা বহন করে চলেছেন এই শ্বেতকালীর ভক্তরা।