বিতর্কিত মামলার রায় দানের আগে সহায় হয়েছিল ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা, বলেছেন খোদ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। অথচ, মামলার বিধানের ক্ষেত্রে বিচারপতিদের দিশা দেখানোর কথা কেবল সংবিধানের, এতদিন তো এ কথাই শোনা যেত। তবে কি বিধানে আর সংবিধানে কি বড় গোল বাধিয়ে ফেললেন বিচারপতি চন্দ্রচূড়?
রাজনীতি বা অন্য যে-কোনওরকম ব্যক্তিগত বিশ্বাসের উপরে আইন-সংবিধানকেই ঠাঁই দিন বিচারপতিরা। এ কথা মনে করিয়েছিলেন খোদ চন্দ্রচূড়। কিন্তু সেই তিনিই সম্প্রতি জানালেন, অযোধ্যার রামমন্দিরের জমি সংক্রান্ত বিতর্কিত মামলায় চূড়ান্ত রায় দেওয়ার আগে তাঁর সহায় হয়েছিল ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা। আর সেই কথাই যেন খানিক অস্বস্তিতে ফেলে দিল গোটা দেশের বিচারব্যবস্থাকে। যে বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে এত কথা, সেই নিরপেক্ষতার যুক্তিতেই কখনও আইনের দেবীর চোখ বাঁধা পড়ে বা কখনও খুলে দেওয়া হয়, সেখানে কোনও বিচারপতির ধর্মবিশ্বাস বা ধর্মীয় আচরণ কি বিচারকে প্রভাবিত করতে পারে? ব্যক্তিগতভাবে যিনি যে-ই বিশ্বাসই পালন করুন না কেন, বিচারের ক্ষেত্রে সেই বিশ্বাসের কথা টেনে আনা কি যুক্তিযুক্ত? তা কি দেশের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের সঙ্গেই সংঘাতে জড়াচ্ছে না?
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, শীর্ষ আদালত যত জটিল মামলা দেখেছে, রাম মন্দির মামলাটি তার প্রথম সারিতেই থাকবে। রাম মন্দির ও বাবরি মসজিদ জমি বিতর্ক নিয়ে মামলাটি চলেছে বছরের পর বছর ধরে। এমনই এক মামলা, যার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল গোটা দেশের আবেগ। ফলে এই মামলায় রায় দেওয়া সহজ ছিল না আদৌ। কিন্তু চন্দ্রচূড় যখন বলছেন যে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনার ফলেই তাঁর মনের জট কেটেছিল এবং তারপরেই তিনি চূড়ান্ত রায় দিয়েছিলেন, তখনই যেন এই সমস্ত আইনি প্রক্রিয়া কোথাও গিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়ছে। সে প্রশ্ন নিরপেক্ষতা নিয়ে। কোনও মামলার বিচার এবং রায়ের ক্ষেত্রে প্রথম এবং শেষ অবলম্বন দেশের সংবিধান। সংবিধান দেশকে যে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের তকমা দেয়, সেই আদর্শ মেনেই দেশের প্রশাসন-আইন-আদালতের কাজ চালানোর কথা। বিশেষ করে যে মামলা ধর্মকে কেন্দ্র করেই, সেখানে সংবিধানের আদর্শকে সর্বতোভাবে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি, যাতে বিচার কোনও এক পক্ষের দিকে ঝুঁকে না থাকে। সেখানে বিচারপতি নিজের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছেন এবং সেই সূত্রেই বিচারের দিশা পেয়েছেন, এ কথা প্রকাশ্যে বললে প্রশ্ন ওঠে, তবে কি নিজের ধর্ম কোনোভাবে প্রভাবিত করল তাঁকে? ধর্ম বদলে গেলে কি বদল দেখা যেত রায়ের ক্ষেত্রেও?
বস্তুত, ব্যক্তিগত জীবনে কে কীভাবে ধর্মাচরণ করবেন বা করবেন না, সেই সিদ্ধান্ত একান্তভাবেই তাঁর নিজের। কিন্তু সামাজিক জীবনে সেই আচরণ অন্য কাউকে কতখানি প্রভাবিত করছে, ধর্মনিরপেক্ষ দেশে তা দেখার দায় থাকে বইকি। বিশেষ করে বিচারপতির মতো কেউ, যিনি সরাসরি সাংবিধানিক কাজে যুক্ত, সংবিধানকে রক্ষা করার দায়িত্বে যুক্ত, তাঁর প্রকাশ্য ভাবমূর্তিটি সম্পূর্ণভাবে নিরপেক্ষ হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এমনিতে ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় যে ঈশ্বরবিশ্বাসী, সে কথা সকলেরই জানা। একাধিকবার তাঁকে নানা মন্দিরেও দেখা গিয়েছে। তা নিয়ে কিন্তু বিতর্কের অবকাশ ছিল না। কিন্তু যখন তিনি বাড়ির গণেশ পুজোয় প্রধানমন্ত্রী মোদিকে আমন্ত্রণ জানান, বা রামমন্দির রায় প্রসঙ্গে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনার কথা বলেন, তখনই বিতর্ক উসকে ওঠে। কেননা এই বিষয়গুলির সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক পরিস্থিতি জড়িয়ে আছে। রাজনীতির প্রসঙ্গে চন্দ্রচূড় নিজেই একসময় বলেছিলেন, গণতান্ত্রিক দেশ ভারত, এখানে কোনও রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে চর্চা বা তর্কে জড়াতে পারেন আইনজীবীরাও, তবে দলীয় স্বার্থকে তাঁদের সরিয়ে রাখতেই হবে। তিনি সাফ বলেছিলেন, আইনজীবীদের কাছে সংবিধান সবার আগে থাকবে। আইনের স্থান হবে রাজনীতির উপরে। সেখানে কোনও পক্ষপাতিত্ব রাখা চলবে না। একইভাবে গণেশ পুজোয় বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের বাসভবনে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে দেখে যখন বিতর্ক উসকে উঠেছে, সেই আবহেই সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি হিমা কোহলি বলেছিলেন, বিচারপতিদের ক্ষেত্রে কোনও ধর্মীয় আচার-আচরণের চিহ্ন সবার সামনে তুলে ধরা উচিত নয়। তাঁর ব্যক্তিগত মত, ধর্মবিশ্বাস এবং ধর্মীয় আচরণ সবকিছুই অত্যন্ত ব্যক্তিগত বিষয়। তা চার দেওয়ালের মধ্যেই থাকা উচিত।
আসলে, ন্যায়বিচারের আশাতেই আদালতের দ্বারস্থ হয় মানুষ। বিচারপতি নিরপেক্ষভাবে বাদী বিবাদী উভয় পক্ষের কথাই খতিয়ে দেখবেন, এমনটাই তাদের আশা। সেখানে কোনও বিচারপতি যদি তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাসের কথা প্রকাশ্যে জাহির করেন, তবে মানুষের আশঙ্কা হওয়াও স্বাভাবিক যে সেই ব্যক্তিগত বিশ্বাসের প্রভাব বিচারে এসে পড়বে। বিচারপতির ধর্মীয় বা রাজনৈতিক পক্ষপাত বিচারকে প্রভাবিত করবে, মানুষ এমনটা ধরে নিলে আইন এবং সংবিধানের পক্ষে তা আশার কথা নয়। বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের মন্তব্যের সূত্রে সেই আশঙ্কাই উসকে উঠেছে। সম্প্রতি নিরপেক্ষতার দোহাই দিয়েই লেডি অফ জাস্টিসের যেমন চোখ খুলে দেওয়া হয়েছে, বিচারপতিরাও যদি তেমনই ব্যক্তিগত বিশ্বাস সরিয়ে খোলা চোখে বিচার করেন, তবে তা দেশের সংবিধানের পক্ষেই স্বস্তির।