প্রতিদিন গড়ে ৩৫ জন। সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন নিজেকে শেষ করে দেওয়ার। এঁরা প্রত্যেকেই পড়ুয়া। নামী প্রতিষ্ঠানের পড়ুয়া। কারও বয়সই খুব বেশি নয়। ঠিক কেন এই বয়সেই আত্মহননের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তাঁরা? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
সুইসাইড ক্যাপিটাল অর্থাৎ আত্মহত্যার রাজধানী, এমনই তকমা জুটেছিল রাজস্থানের কোটা শহরের। সমীক্ষায় ধরা পড়ে, এখানেই পড়ুয়াদের আত্মহত্যার হার সবথেকে বেশি। তবে সামগ্রিক ভাবে দেখলে পিছিয়ে নেই দেশের অন্যান্য রাজ্যও। বরং তথ্য বলছে মহারাষ্ট্রে পড়ুয়াদের আত্মহত্যার হার সবথেকে বেশি। গোটা দেশের নিরিখে দেখলে বিগত কয়েক বছরে কয়েক লক্ষ পড়ুয়া নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
আরও শুনুন:
৫ বছরে আত্মহত্যা ৯৮ পড়ুয়ার! উদ্বেগ বাড়াচ্ছে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পরিস্থিতি
আত্মহত্যা মহাপাপ। এ কথা শাস্ত্রে বলে। আইনও এই মৃত্যুকে অপরাধের আখ্যা দেয়। আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে কড়া শাস্তির মুখে পড়তে হয়। তার সঙ্গে সমাজের অপমান তো রয়েছেই। তবু সব কিছু ছেড়ে পালিয়ে যেতে চান অনেকেই। ঠিক যেমনটা চেয়েছিলেন থ্রি ইডিয়েটস-এর রাজু রাস্তোগি। সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলেন রাজু। নতুন করে জীবন শুরু করেছিলেন। সবার ক্ষেত্রে গল্পটা তেমন হয় না। তাই হিসাব বলছে, গোটা দেশে প্রতিদিন নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন গড়ে ৩৫ জন পড়ুয়া। এই নিয়ে আলোচনা কম হয়নি। পদক্ষেপও করা হয়েছে। কোথাও সিলিং ফ্যানে খাঁচা বসানো, কোথাও সিসিটিভি বসিয়ে কড়া নজরদারি, তাও আত্মহত্যার সংখ্যা কমানো যায়নি। হয়তো এতকিছু না করে পড়ুয়ারা কী চাইছেন সেদিকে নজর দিলে ভালো হত। একে বিতর্কের বিষয় বলে দাগিয়ে দেবেন অনেকে। পড়াশোনার চাপ না নিতে পারাটা পড়ুয়াদের ব্যর্থতা এমনটাও অনায়াসে বলে দিতে পারেন কেউ কেউ। কিন্তু যে মায়ের কোল খালি হল, তিনিই বোঝেন যন্ত্রণার মানে!
আরও শুনুন:
রিক্লেম দ্য রাইটস! মেয়েদের অধিকারের জন্য টানা অনশন, ‘হাঙ্গার স্ট্রাইক মেডেল’ পান এই নারী
পড়াশোনায় ভাল মানেই সাফল্যের সিঁড়িটা অনেকখানি হাতের নাগালে। ভাল কলেজে পড়ার সুযোগ পেলে তো কথাই নেই। বিশেষ করে যদি তা কোনও বৃত্তিমূলক শিক্ষা হয়, যেখানে ভালভাবে পাশ করলেই নিশ্চিত চাকরির আশ্বাস। অথচ, এর কোনও কিছুই যেন আশার আলো জ্বালাতে পারছে না একটা বড় অংশের পড়ুয়ার চোখের আঁধারে। সামনে যতই সুখ স্বাচ্ছন্দ্য স্বপ্নের হাতছানি থাকুক না কেন, দেখা যাচ্ছে, তার কোনও কিছুই যেন আর বেঁচে থাকার রসদটুকু জোগাতে পারছে না তাদের। তাই আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে পড়ুয়াদের মধ্যে। তালিকায় ছেলেদের মতোই রয়েছে মেয়েরাও। সমীক্ষা বলছে, ,মহিলাদের মধ্যে সবথেকে বেশি আত্মহত্যা করেন গৃহবধুরা। তারপরেই রয়েছেন ছাত্রীরা। ন্যাশানাল ক্রাইম ব্যুরোর রিপোর্ট বলছে, ২০২২ সালে প্রায় ১.২২ লক্ষ পুরুষ আত্মহননের পথে হেঁটেছে। এর মধ্যে পড়ুয়ার সংখ্যা প্রায় ৭ হাজার। মহিলাদের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ৪৮ হাজার, তার মধ্যে পড়ুয়া ৬ হাজার। রাজ্যের হিসাবে দেখলে শীর্ষে রয়েছে মহারাষ্ট্র। তারপরেই তামিলনাড়ু, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খন্ডের মতো একাধিক রাজ্য রয়েছে। ২০২২ সালে মহারাষ্ট্রে প্রায় ১৮০০ জন পড়ুয়া আত্মহত্যা করেছেন। তালিকার শুরুর দিকে থাকা অন্যান্য রাজ্যেও সংখ্যাটা ১০০০ এর কম নয়।
কিন্তু কেন এই মৃত্যুর ঢল?
সঠিক তথ্য নেই কারও কাছে। কেউ খোঁজার প্রয়োজনও মনে করেনি খুব একটা। বরং উত্তরোত্তর বেড়েছে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার চাপ রাজস্থানের কোটার নাম এক্ষেত্রে না তুললেই নয়। প্রাশয়ই খবরের কাগজের শিরোনাম দখল করে এই শহরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। স্রেফ কারিগরি সাফল্যের জন্য নয়, পড়ুয়াদের আত্মহত্যার জন্যও। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, আত্মহত্যার কারণ হিসেবে লেখা চিঠিতে মৃত পড়ুয় বারবার উল্লেখ করেছেন এই চাপের কথা। যা না চাইতেও চাপিয়ে দেওইয়ার চেষ্টা হয়েছে। সুনাম যেন না কমে, সেটাই একমাত্র উদ্দেশ্য, তার জন্য যে কোনও মূল্য দিতে প্রস্তুত এইসব প্রতিষ্ঠানেত্রত কর্মকর্তারা। তা সে পড়ুয়ার জীবন হলেও আপত্তি নেই।
আরও শুনুন:
আত্মহত্যায় বিশ্বের শীর্ষে ভারত! প্রতিদিন আত্মহননের পথে হাঁটেন গড়ে ১৬০ জন তরুণ
মনে রাখা দরকার, এই নামী প্রতিষ্ঠানগুলিতে যাঁরা পড়াশোনা করেন, তাঁদের অধিকাংশকেই থাকতে হয় বাড়ি থেকে দূরে। কোটার কোচিং সেন্টারগুলি এমনিও আবাসিক, জীবন সেখানে কড়া অনুশাসনে বাঁধা। অস্বাভাবিক নিয়ম, অগণিত পরীক্ষা, বিশ্রামহীন রুটিনের জন্য একরকম কুখ্যাতিই রয়েছে সেই কেন্দ্রগুলির। ভাড়াবাড়ি বা পেয়িং গেস্ট ব্যবস্থায় কোনও মতে থাকা, দিনে পনেরো-ষোলো ঘণ্টা পড়াশোনা, এক ঘণ্টা বেশি ঘুমোতে চাইলে কর্তৃপক্ষের ভর্ৎসনা ও ধিক্কার— এই জীবন হয়তো নিতে পারেন না অনেক পড়ুয়াই। তুমুল প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে হেরে যাওয়ার ভয়ে, চিরতরে নিজেদের হারিয়ে ফেলেছেন এঁরা। এর আগেও জাতীয় সমীক্ষায় ধরা পড়েছে আত্মহত্যার সংখ্যা কীভাবে বাড়ছে দেশের সবর্ত্র। বারবার উঠে এসেছে দেশের যুবদের কথাই। কখনও পড়ুয়া, কখনও সদ্য চাকরিতে যোগ দেওয়া কেউ নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছে। বিশেষজ্ঞ মহল এই নিয়ে একাধিকবার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। এই ধরনের পরিণতি হতে পারে সেই আভাসও দেওয়া হয়েছে বারবার। তবু বদলায়নি কিছুই। অবশ্য আগামীদিনেও তা কতটা বদলাবে, সে উত্তর সময়ই দেবে।