গোটা রেলগাড়ি জুড়ে মারণরোগীদের ভিড়। সকলেই যাচ্ছেন চিকিৎসা করাতে। কজন ফিরবেন, সে কথা কেউ জানে না। আরও কতজন সওয়ার হবেন, সেই হিসাবও নেই কারও কাছে। তবু প্রতিদিন, নির্দিষ্ট সময় গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দেয়, ‘ক্যানসার ট্রেন’। আসুন শুনে নেওয়া যাক।
ক্যানসার ট্রেন! এমনই নাম। আমজনতার দেওয়া। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় ছাড়ে, গন্তব্যে পৌঁছয়। আবার ফিরেও আসে। বিশেষভাবে আলাদা কিছুই নেই এতে। স্রেফ নাম আর যাত্রীদের অবস্থা ছাড়া। নামের প্রসঙ্গেই সে হদিশ মেলে। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, এই ট্রেনের অধিকাংশ যাত্রীই ক্যানসার রোগী।
ভারতীয় পরিবহনে রেল একটা বড় জায়গা দখল করে রাখে। দূরে হোক বা কাছে, রেলপথে যাতায়াত অনেকের কাছেই সবথেকে সহজ হিসেবে গণ্য হয়। কোথাও আবার রেল ছাড়া যাতায়াতের উপায়ও নেই। নিত্যযাত্রীদের কাছে রেলগাড়ি খানিকটা দ্বিতীয় বাড়ির মতো। তাই এদেশে ‘ক্যানসার ট্রেন’ কল্পনা করা এমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বেছে বেছে এই একটি ট্রেনেই কেন সওয়ার হন মারণরোগীরা?
আসলে, উপায়ও নেই। যে ট্রেন সম্পর্কে বলছি সেটি পাঞ্জাবের। রেলের দেওয়া নাম আবোহার-যোধপুর প্যাসেঞ্জার। প্রতিদিন রাত সাড়ে ৯ টা নাগাদ পাঞ্জাবের ভাটিণ্ডা স্টেশন থেকে রওনা দেয়। পরদিন ভোরে পৌঁছয় রাজস্থানের বিকানের শহরে। এখানকার স্থানীয় এক হাসপাতালে চিকিৎসা করাতেই হাজির হন পাঞ্জাবের ক্যানসার রোগীরা। সেক্ষেত্রেই কাজে আসে এই বিশেষ ক্যানসার ট্রেন। আসলে, এই ট্রেনে ভাড়া হিসেবে ক্যানসার রোগীদের কোনও টাকা দিতে হয় না। রোগীর পরিবারের তরফে কেউ গেলে তাতেও কিছুটা ভাড়া মুকুব হয়। তাতেই প্রতিদিন শয়ে শয়ে মারণরোগী এই ট্রেনে সওয়ার হন। তাতেও প্রশ্ন থেকেই যায়, এতবড় পাঞ্জাবে ক্যানসার চিকিৎসার সুযোগ নেই? উত্তরটা অবশ্যই ইতিবাচক। কিন্তু সেই চিকিৎসা সকলের পক্ষে করানো সম্ভব নয়। মূলত এই রাজ্যের বেসরকারি হাসপাতালগুলিই ক্যানসার চিকিৎসার জন্য ভালো। তাঁর খরচও তেমনই। সরকারি জায়গায় যেভাবে চিকিৎসা হয়, তাতে ভরসা করতে পারেন না রোগীরা। তাই ভরসা একটাই, ক্যানসার ট্রেন!
রাজস্থানের যে হাসপাতালে পাঞ্জাবের রোগীরা চিকিৎসার জন্য যান, সেখানেও সবটাই প্রায় বিনামূল্যে হয়। সামান্য টাকায় চিকিৎসা, খাওয়া-দাওয়ার জন্যও তেমন খরচ নেই। থাকার জন্য যে ধর্মশালা রয়েছে তাতেও খরচ নামমাত্র। তাই সকলেই চিকিৎসার জন্য এতদূরের পথ পেরোতে দুবার ভাবেন না। এদিকে, পাঞ্জাবে ক্যানসার রোগীর সংখ্যাও প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তার কারণ অবশ্য একাধিক। কৃষিপ্রধান এই রাজ্যের অধিকাংশ বাসিন্দাই চাষবাস করে জীবিকা নির্বাহ করেন। সেখানে কীটনাশক ব্যবহার হয় রীতিমতো। এর থেকেই ক্যানসারের বীজ ছড়িয়ে পড়ছে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। একাধিক সমীক্ষায় সে তথ্য ধরা পড়েছে। শুধু কীটনাশক নয়, কলকারখনার ভারী ধাতুর বর্জ্য জলে মিশে ক্যানসারের প্রবণতা বাড়িয়েছে। এ নিয়ে একাধিক পদক্ষেপ করা হলেও সুরাহা মেলেনি। উত্তরোত্তর বেড়েছে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা। তা স্পষ্ট হয় প্রতিদিন ভাটিণ্ডা স্টেশনে পৌঁছলেই। একটু সন্ধ্যে হলেই স্টেশনে ভিড় জমাতে শুরু করেন মারণরোগীরা। আবার ফিরে আসবেন এই আশাতে ট্রেনে চড়েন তাঁরা। সকলের আশা পূরণ হয় না। তাও নতুন করে, নতুন আশা নিয়ে, ক্যানসার ট্রেনে সওয়ার হন রোগীরা।