কোজাগরী অর্থ জেগে থাকা। বিপদে, সংকটে সেই জাগরণের ধর্ম পালন করেছেন এই নারীরা। সেই ধর্ম মেনেই সমাজকে এগিয়ে দিয়েছেন সমৃদ্ধির পথে। তবে সমাজ ‘লক্ষ্মী মেয়ে’ বলতে মেয়েদের যে চুপ করে থাকা চেনে, সেই তকমাকে তাঁরা স্বীকারই করেননি আদৌ। প্রয়োজনে তাঁরা প্রতিবাদ করেছেন, রুখে দাঁড়িয়েছেন, আর সেই প্রতিবাদেই আরও একটু উত্তরণের পথে এগিয়েছে এই দেশ। শুনে নিন অন্যরকম এই লক্ষ্মীদের গল্প।
সমৃদ্ধি আনেন দেবী লক্ষ্মী, প্রচলিত বিশ্বাস এ কথাই বলে। এই মেয়েরাও সমৃদ্ধি আনেন। কেবল নিজের পরিবারে নয়, সমাজের, দেশের জন্য সমৃদ্ধি। যে সমৃদ্ধি আসলে ভালো থাকা। গোটা সমাজকে ভালোর দিকে এগিয়ে দেওয়া। কিন্তু সেই সমাজ ‘লক্ষ্মী মেয়ে’ বলতে মেয়েদের যে চুপ করে থাকা চেনে, সেই তকমাকে তাঁরা স্বীকারই করেন না আদৌ। প্রয়োজনে তাঁরা প্রতিবাদ করেছেন, রুখে দাঁড়িয়েছেন, আর সেই প্রতিবাদেই আরও একটু উত্তরণের পথে এগিয়েছে এই দেশ।
এঁদেরই একজন লক্ষ্মী স্বামীনাথন। সিঙ্গাপুরের বিশিষ্ট স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ এই নারী নেতাজির ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে। ১৯৪৩ সালে আজাদ হিন্দ ফৌজের রানি ঝাঁসি রেজিমেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। নেতাজিকে গার্ড অফ অনার দেওয়ার জন্য রাইফেল হাতে কুড়িজন মেয়েকে তালিম দিয়েছিলেন লক্ষ্মী। তা দেখেই নেতাজি তাঁকে বলেন, ফৌজে যাওয়া কিন্তু এমন আনুষ্ঠানিক বিষয় নয়, বর্মার জঙ্গলে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রশ্ন করেন, কবে কাজ শুরু করতে পারবে? লক্ষ্মীর ঝটিতি জবাব ছিল, আগামী কাল থেকে। ঝাঁসির রানি বাহিনীর ইম্ফলে ঢোকার সময়ে নেতৃত্ব দেন লক্ষ্মী। মেমিও হেডকোয়ার্টার্স পরিদর্শনে এলেন নেতাজি। সে রাতেই চাঁদের আলোয় প্রবল বোমাবর্ষণে বিধ্বস্ত হয়ে গেল তাদের ব্যারাক। মেমিওর কাছে কালাউতে ইংরেজদের হাতে বন্দি হলেন লক্ষ্মী।
ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী স্বামীনাথন পরে আইএনএর আরেক সেনানায়ক প্রেম সেহগলকে বিয়ে করে লক্ষ্মী সেহগল নামে পরিচিত হন। স্বাধীন ভারতেও রাজনীতির চর্চা ছাড়েননি। যোগ দেন বামপন্থী রাজনীতিতে। তাঁর যুক্তি ছিল, নেতাজি শিখিয়েছিলেন সারাজীবন মানুষের জন্য কাজ করবে। তিনি যখন সেই কাজের বৃহত্তর পরিধি খুঁজছেন তখন যে রাজনৈতিক সুযোগ আসে তিনি তা মন থেকে গ্রহণ করেন। সমাজের হিসেবে হয়তো তিনি ‘লক্ষ্মী মেয়ে’ নন। কিন্তু দেশ ও মানুষের জন্য আজীবন কাজ করে যাওয়া এই বীরাঙ্গনাকে পেয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে দেশই।
অন্যরকম লক্ষ্মীদের গল্প বলতে হলে আরেক মেয়ের কথা না বলে উপায় নেই। তিনি লক্ষ্মী আগরওয়াল। বছর পনেরোর কিশোরী গায়িকা হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। ইচ্ছে ছিল রিয়ালিটি শো-এ যাওয়ার। বাড়িতে প্রবল আপত্তি। বইয়ের দোকানে কাজ করে সংসারে টাকা দিয়ে পরিবারকে শান্ত করেন, পাশাপাশি নিজের জেদ বাঁচিয়ে রাখেন। কিন্তু ঘরে বাইরে সর্বত্রই তো মেয়েদের লক্ষ্মী হওয়ার নিয়মটা এক, যে যা বলে সবার কথা মেনে চলা। তাই, বত্রিশ বছরের এক পুরুষের বিয়ের প্রস্তাব নাকচ করতেই লক্ষ্মীর উপর ধেয়ে এল অ্যাসিড আক্রমণ। মেয়েদের ‘না’ মানে ‘না’, এ কথা কে শুনতে চায়! ডাক্তারেরা বলেছিলেন, বাঁচানো যাবে না। লক্ষ্মী জানতেন, তাঁকে বাঁচতেই হবে। নিজের কথা বলার জন্য।
লক্ষ্মী মেয়ের মতো চুপ করে থাকেননি লক্ষ্মী। শারীরিক কষ্ট, সমাজের চাপ, বিয়ে হবে না বলে উড়ো কটাক্ষ, গায়িকা হওয়ার স্বপ্ন হারিয়ে যাওয়া, একটা একটা করে প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে গিয়েছেন। হামলার একশো দিন পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন লক্ষ্মী। সেদিনই আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলেন, আর সেদিনই ভেবেছিলেন ফের বেঁচে ওঠার কথা। তারপরেই অ্যাসিড সারভাইভার-দের জন্য লড়াইয়ে নামেন লক্ষ্মী আগরওয়াল। দেশ জুড়ে অবাধে অ্যাসিড বিক্রির বিপদের দিকে সুপ্রিম কোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছিলেন তিনি। ‘স্টপসেলঅ্যাসিড’-এর ডাক দিয়ে বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরেছেন তিনি। লড়াই আর সাহসিকতার জন্য আমেরিকার প্রাক্তন ‘ফার্স্ট লেডি’ মিশেল ওবামার হাত থেকে পুরস্কার পেয়েছেন এই বীরাঙ্গনা।
সারা দেশ জুড়ে অ্যাসিড আক্রান্ত মহিলাদের সঙ্গে থাকা। ‘শিরোজ’-এর মতো অ্যাসিড সারভাইভারদের নিয়ে প্রথম ক্যাফে চালানো। দেশে অ্যাসিড বিক্রির ক্ষেত্রে আইন চালুর দাবিতে লড়াই করা লক্ষ্মী। তিনি যদি লক্ষ্মী মেয়ে না হন, আর কে?