বাঙালি বাড়িতে লক্ষ্মীর ভাঁড় থাকবেই। মূলত ঠাকুরের আসনেই। পুজোর সঙ্গে সরাসরি যোগ না থাকলেও লক্ষ্মীর ভাঁড় বঙ্গজীবনের অঙ্গ।
মাটির ভাঁড়। ঠাকুরের আসনে রাখা। প্রায় সব বাড়িতেই। তেমন কারুকাজ নেই। সাদামাটা, লাল রঙের চেহারা। উপরের দিকে একটা ফাঁক। সেখান দিয়ে ভিতরে দেখার জো নেই। পুরোটাই অন্ধকার। যা আসলে আলোর উৎস। সবাই বুঝতে পারেন না। বাড়ির লক্ষ্মীরা পারেন। জরুরি নয় সেই ‘লক্ষ্মী’ মা কিংবা ঠাকুমাকেই হতে হবে। বাড়ির একমাত্র উপার্জনকারী পুরুষও অনায়াসে আগলে রাখতে পারেন, ‘লক্ষ্মীর ভাঁড়’।
বাঙালির একেবারে নিজের বলতে যা কিছু, তাতে লক্ষ্মীর ভাঁড়কে জায়গা দিতেই হয়। দেবী পুজোর সঙ্গে এর সরাসরি যোগ নেই। তবু বাংলার লক্ষ্মী আরাধনা ভাঁড় ছাড়া অচল। যার যা সামর্থ, যেটুকু বাড়তি, জমিয়ে রাখা। খুচরো কয়েন মূলত। কখনও তাতে নোটও জমে। হিসাব করে কেউ দেখে না কত জমা পড়ল। হিসাব রাখাও যায় না। তবু ম্যাজিকের মতো বিপদের বন্ধু মধুসূদন হতে পারে এই লক্ষ্মীর ভাঁড়। কখনও বোনের স্কুল ফি-র টাকা কম পড়লে লক্ষ্মীর ভাঁড়ে হাত পড়ে। কখনও আবার দাদুর দামি ওষুধ কিনতে কিছুটা কম পড়লে ভরসা লক্ষ্মীর ভাঁড়। আরও কত কি! শুধু বিপদের ভরসা বললেও ভুল হয়। স্বপ্নের জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার জন্য টাকা জমবে লক্ষ্মীর ভাঁড়ে। বাইক, সাইকেল এমনকি ফোন কেনার টাকাও, যত্ন করে জমিয়ে রাখবে লক্ষ্মীর ভাঁড়।
ঠিক কবে থেকে এই লক্ষ্মীর ভাঁড় বঙ্গ জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠল তার হদিশ মেলে না। এর নাম কেন লক্ষ্মীর ভাঁড়, সেই নিয়েও নানা মুনির নানা মত। শুধু প্রশ্ন ওঠে না লক্ষ্মীর ভাঁড়ের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে। কারণ, এ হল এমন এক জিনিস, যা স্বপ্নপূরণ করে, আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শেখায়। সিনেমা-গল্পে যেভাবে লক্ষ্মীর ভাঁড় দেখানো হয়, তাতে বাড়ির মহিলারৈ প্রাধান্য পান। লুকিয়ে টাকা জমানোর দায়িত্ব যেন শুধুমাত্র তাঁদের একার। আসলে ব্যাপারটা মোটেও তেমন নয়। বাড়ির পুরুষও অনায়াসে টাকা জমাতে পারেন লক্ষ্মীর ভাঁড়ে। অনেকের বাড়িতে সে চলও রয়েছে। নিয়ম করে পুজোর পর লক্ষ্মীর ভাঁড়ে সামান্য কিছু জমিয়ে রাখা অভ্যাস অনেক পুরুষের। রোজ না হোক, বৃহস্পতিবারে লক্ষ্মীর ভাঁড়ে টাকা রাখলে সংসারে মঙ্গল হবে, এমনটা বিশ্বাস।
মাটির তৈরি এই ভাঁড় কোচবিহারে বেশ জনপ্রিয়। একসময় সেখান থেকেই গোটা বাংলায় সরবরাহ হত। ধীরে ধীরে বাংলার অন্যান্য সমস্ত জায়গার মৃৎশিল্পীরাও তৈরি করতে শুরু করেন। বিভিন্ন মেলায় লক্ষ্মীর ভাঁড় বিক্রি হয় এখনও। সঙ্গে থাকে হরেক রকম মাটির পুতুল। আবার ভাঁড়ের আকারও বদলে যায় অনেক সময়। পেঁচা, হাঁস, কিংবা কোনও সবজি আকারের লক্ষ্মীর ভাঁড় হতেই পারে। ভিতরটা ফাঁপা হলেই হল। বাহারি লক্ষ্মীর ভাঁড় অনেকে জমিয়েও রাখেন। কারণ এই ভাঁড়ে টাকা তোলার উপায় একটাই, ভেঙে ফেলা। সাধারণ ভাঁড় ভাঙতে সমস্যা নেই। কিন্তু দেখতে সুন্দর হলে তা ভাঙতে মন যায় না। বেশিরভাগ বাড়িতেই উদ্দেশ্যহীন ভাবে টাকা জমানো হয় লক্ষ্মীর ভাঁড়ে। অর্থাৎ একটা সময়ের পর তা ভাংতেই হবে এমন বাধ্যবাধকতা নেই। জমছে জমুক। ভর্তি হলে নতুন ভাঁড় আসবে। তাতেও টাকা জমবে। ভাঙা হবে প্রয়োজনে।
আসলে, লক্ষ্মী বড় চঞ্চলা। সামান্য ভুল হলেই লক্ষ্মী ঘরছাড়া হবেন। এদিকে টাকা মানেই লক্ষ্মী। তাই তাকে ভাঁড়ে আটকে রাখাও ঘরে লক্ষ্মীর রাখার মতোই। সেই হিসাবে এর ঠাঁই ঠাকুরের আসনে। শুদ্ধচিত্তে, পরিষ্কার জামাকাপড় পরেই ছোঁয়া যাবে লক্ষ্মীর ভাঁড়। নাহলে আর কিছু হোক না হোক, বাড়ির বড়দের কানমলা জুটবে। শাস্ত্রের নিয়ম থাকুক বা না থাকুক, বাংলার ঘরে ঘরে লক্ষ্মীর মতোই আদরে, যত্নে ভক্তিতে রাখা থাকে লক্ষ্মীর ভাঁড়।