মাতৃপক্ষ। মায়ের কাছেই সকল চাওয়া। চোখ বন্ধ করে। খোলা চোখে অবশ্য অপ্রাপ্তি। বিস্তর। মা আর মেয়েদের পাওনার ঘরে ঘরে আজও মস্ত ঢ্যাঁড়া। সেই কথা নতুন করে বলাই হোক এবারের অঞ্জলি মন্ত্রে। হয়তো এ অন্যরকম, অথবা এ-ই স্বাভাবিক।
দেবীপক্ষে মায়ের কাছে লেডিজ টয়লেটের দাবি জানালেন তিতাস রায় বর্মন। পড়ে শোনাচ্ছেন, চৈতালী বক্সী। অলংকরণে দীপঙ্কর ভৌমিক।
অনেকদিন ধরেই কথাগুলো বলা হচ্ছিল, কিন্তু কান দেয়নি কেউ।
এই তো কিছুদিন আগেই, ২০২৪ সালের আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারীদিবস উপলক্ষে নারীদিবস প্রতিবাদ মঞ্চের তরফ থেকে একমাসব্যাপী প্রচার চালানো হয়েছিল– বিভিন্ন ক্ষেত্রে মেয়েদের, বিশেষত শ্রমজীবী নারীদের সমস্যাগুলোকে সামনে এনে। কেউ কেউ জেনেছিল সমস্যাগুলো, বেশিরভাগই শোনেনি, অধিকাংশ দেখেও দেখেনি। আর রাষ্ট্র পাত্তাই দেয়নি।
তারপর আরও কয়েক মাস পর থিয়েটারের মেয়েরা ও প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার মানুষেরা সুরক্ষার দাবিতে রাস্তায় নামল। নিজেদের জেদে তারা বানাল ‘সুরক্ষা ইস্তেহার’। তারা চেয়েছিল এই সমস্যার সমাধান হবে কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে, সরকারের তরফে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হবে, কিন্তু সেই লড়াই শেষমেশ হয়ে দাঁড়াল নিজেদের মধ্যে সুরক্ষা বলয় তৈরি করে। রাষ্ট্র কোনও দায় নিল না। কোনও হেনস্তাবিরোধী দপ্তর তৈরি হল না।
এরও কয়েক মাস পর আরজিকরের ঘটনা ঘটল।
আপাতত যা বললাম, এ সবকিছুরই চূড়ান্ত গন্তব্য হওয়ার কথা হেনস্তা বা ধর্ষণের সংস্কৃতি উপড়ে ফেলার ব্যবস্থা তৈরি করায়। সেখানে আমরা দেখলাম, ধর্ষণ হলে তা যেন নথিভুক্ত হয় এবং ধর্ষকের যেন শাস্তি হয়– এইটুকু দাবি নিয়ে মেয়েরা রাস্তায় নামছে, রাত জাগছে। এগুলো নিশ্চয়ই খুবই জরুরি দাবি। কিন্তু এটা ন্যূনতম। আমরা এই ন্যূনতমটুকুও আজ অবধি পাইনি। আমরা চেয়েছি আর একটা মেয়েও যেন ধর্ষিত না হয়। কিন্তু আমাদের এই চাওয়ায় কী-ই বা এসে যায় পিতৃতন্ত্রের এবং রাষ্ট্রের? তাই, আর জি করের ধর্ষণ কাণ্ডের দিনকয়েক পরেই, মেয়েদের প্রতিবাদী রাত দখল পর্বেই মরে যেতে হল আরও একটি মেয়েকে। বীরভূমের সেই মেয়েটি দিন আনি দিন খাই বর্গের। বাড়ি থেকে দূরে, কিছুটা পথ গিয়ে তবে বাথরুমে যাওয়া যায়। রাতে বাথরুমে যেতে গিয়েই খুন হতে হয় সেই মেয়েটিকে, তবে পুলিশের তথ্য বলছে ধর্ষণের প্রমাণ মেলেনি।
তাই আমাদের লড়াই সামান্য বাথরুম নিয়েও। অবিশ্বাস্য, কিন্তু সত্য বটে!
অনেক দিন ধরেই কথাগুলো বলা হচ্ছিল, কিন্তু কান দেয়নি কেউ। কিন্তু আজ দীর্ঘ ৫৫ দিন ধরে যখন ধর্ষণের বিরোধিতা করে পশ্চিমবঙ্গে আন্দোলন চলছে, তখন মেয়েদের ন্যূনতম দাবিগুলো আবার প্রকট হয়েছে। সুযোগ এসেছে লড়াকু মেয়েগুলোর আবারও একই কথা বলে বলে বলে বলে আকাশ চৌচির করে দেওয়ার। কারণ আজকাল কিছু বেশি সংখ্যক মানুষ কথা শুনছে। এই সুযোগ মেয়েরা সচরাচর পায় না। এই কথাগুলো বলতে দেওয়া হয় না। কর্মরত মেয়েদের আজ যখন সুযোগ এসেছে বলার ও কিছু পাওনা হাতিয়ে নেওয়ার, তখন একটা সামান্য চাহিদার কথা জানাব। সামান্য, এবং একটা চাহিদা। বাথরুমের চাহিদা।
এখনও শহরের বস্তি অঞ্চলে গেলে দেখা যায় একটা গোটা মহল্লায় একটা বাথরুম এবং সেখানে ছেলেদের ও মেয়েদের জন্য একটাই বাথরুম বরাদ্দ। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, সেই বাথরুমের পাকা দেওয়ালও নেই। কাপড় বা চট বা প্লাস্টিক দিয়ে ঘেরা। মাথায় ছাদ থাকে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। কোনও গোপনীয়তা নেই। পাশ দিয়েই লোকে হেঁটে যাচ্ছে। তাকাচ্ছে। ছবি তুলে নিচ্ছে, ভিডিও করে নিচ্ছে। আমারই এক পরিচিত, আসমিনকে, রাতের বেলা বাথরুম যাওয়ার পথে হেনস্তা হতে হয় পাড়ারই একটা ছেলের দ্বারা। তার নামে পুলিশে অভিযোগ করা হলে পাড়ার লোকেরা আসমিনেরই বিরুদ্ধে চলে যায়। পাড়ার কারও নামে অভিযোগ করে পাড়ার বদনাম করা হয়েছে, এই ছিল আসমিনের প্রতি ওর লোকালয়ের অভিযোগ। আসমিন তাই পাড়ায় এখন একঘরে, তার হেনস্তার কথা কেউ শোনেনি। বাথরুম আজও পাকা হয়নি, আলাদা হয়নি।
বাজারে কোনও বাথরুম নেই। এদিকে মেয়েরা ভোর রাত থেকে শাক-সবজি, মাছ-মাংস নিয়ে এসে বসে। তাদের বাথরুমের সুবিধা নেই। সারাদিন বাথরুম চেপে বসে থাকে, অসুস্থ হয়ে পড়ে, ইউটিআই হয়, হাতুড়ে ডাক্তার দেখায়, অসুখ সারে না, মহিলাজনিত সমস্যা বেড়ে যায়, মাসিক সংক্রান্ত সমস্যা শুরু হয়। চিকিৎসা হয় না। এদিকে বাজারে মেয়ে বিক্রেতাদের সংখ্যা বেশি। বাজার এই মেয়েদের কর্মস্থল। তারা কর্মস্থলে এই ন্যূনতম সুযোগটি পায় না। এদিকে ‘মেয়েরা আর ছেলেদের থেকে পিছিয়ে নেই, সমান তালে কাজ করছে’, বলে এই সমাজ গর্বে বুক ফোলায়। সমস্যা হল, আমরাও, মেয়েরাও কাজের কিছু সুযোগ পেয়েছি বলে, কিছুটা রোজগার করতে পারছি বলে কর্মস্থলের সমস্যাগুলোকে তুলে ধরছি না। ভাবছি এই সমস্যার কথা বললে যদি কাজের সুযোগটিও হারাই? তাই কর্মস্থলে বাথরুমের সুযোগ নেই– এই কথাটা সোচ্চারে বলতে পারছি না। কাজের দায়ে মেনে নিচ্ছি।
এভাবেই মহিলা গিগ ওয়ার্কাররা সারাদিন-সারারাত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ডেলিভারি করছে, কিন্তু কোনও বাথরুম পাচ্ছে না। তার ওপর গিগ ওয়ার্কারদের বসতি এলাকাগুলোতে ডেলিভারি করতে যেতে হয়, সেখানে তো আরও সুলভ শৌচালয় নেই। যে ক’টা সুলভ রয়েছে, তা একেবারে শহরের প্রাণকেন্দ্রে কয়েকটা। বসতি এলাকায় নয়। এই তো কিছুদিন আগে মহিলা ডেলিভারি কর্মীদের বাথরুম সমস্যা নিয়ে অনেক লেখালেখি হল, তবুও কাঠামোগত কোনও বদল আনা গেল না। এমনকি, জনমানস থেকে সমস্যার কথাটাই উবে গেল। মাসিক হলে তো কথাই নেই, গোটা দিন একই স্যানিটারি ন্যাপকিন পরে কাটিয়ে দেওয়া। বদলানোর উপায় নেই।
গৃহশ্রমিক মেয়েরা বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে, কিন্তু সেইসব বাড়িতে তাঁদের বাথরুম ব্যবহার করা ‘নিষিদ্ধ’। তাঁরাও কিন্তু তাঁদের কর্মক্ষেত্রে এসেছে, তবুও বাথরুম ব্যবহার করার জো নেই। মালিকদের বাড়ির বাথরুমে তাঁদের প্রবেশ নেই। এই মেয়েদের বাথরুমের ব্যবস্থা করবে কে? কেন যে বাড়িতে কাজ করে, সে বাড়িতে বাথরুম করার সুযোগ পাবে না। কেন শ্রেণির বিকট রূপ এখানে প্রকাশ পাবে? তা নিয়ে এখনও কোনও প্রতিবাদ তেমন জোরালো হল না কেন যেখানে এমন ব্রাহ্মণ্যবাদী, বৈষম্যমূলক প্রথা বন্ধ হয়ে যায়!
আর যে কর্মস্থলে মেয়েদের বাথরুমের সুযোগ আছে, সেখানে বাথরুমের পরিস্থিতি কেমন, সেটাও এ প্রতিবেদনে লেখা খুব জরুরি। লেখা দরকার, অধিকাংশ মেয়েদের স্কুলে, কলেজে বাথরুমের পরিস্থিতি কেমন। কেন একটু প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক মেয়েকেই ঋতু শুরু হলে স্কুলছুট হতে হয়। এমনকি মফসসল শহরতলিতে ‘ভালো স্কুল’-এর তকমা পাওয়া একাধিক স্কুলে বাথরুমের অবস্থা ভালোর ঠিক উলটো। বলা দরকার, বইপাড়ার মতো শৈল্পিক পরিসরে ‘লেডিজ টয়লেট’ বিষয়টি কেমন অপরিচ্ছন্ন অথবা অপ্রতুল। অধিকাংশ সংস্থাতেই মেয়েদের বাথরুম স্বাস্থ্য-বান্ধব নয়। নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না, স্যানিটারি ন্যাপকিন ফেলার সুবন্দোবস্ত নেই। কর্মরতা ভাগ্য খুব ভালো হলে, বড়জোর দিনে একবার পরিষ্কার করা হয়। কিন্তু মেয়েদের বাথরুম ঘণ্টায় ঘণ্টায় পরিষ্কার করা উচিত স্বাস্থ্যের কারণে। কিন্তু যে প্রতিবেদনে বাথরুমের অধিকার নিয়ে কথা বলা হয়, সেখানে বাথরুমের ‘স্যানিটাইজেশন’ নিয়ে প্রশ্ন করাটা বাতুলতা মনে হয়। মনে হয়, ন্যূনতমের বাইরের অধিকার নিয়ে কথা বলার সময় এসেছে কি?
বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের আলাদা বাথরুম থাকার কথা যে কোনও জনপরিসরে। অথচ ঝাঁ চকচকে শহরেও একাধিক জায়গায় তা মেলে না। যে কারণে হুইলচেয়ারে চলা অনেক নারীকে প্রয়োজনে ক্যাথিটার ব্যবহার করতে হয়। জল খেতে হয় মেপে।
সব লেখাতেই যাঁদের কথা বাদ পড়ে যায়, তাঁরা হলেন প্রান্তিক লিঙ্গ যৌনতার মানুষেরা। রূপান্তরকামী মানুষদের আলাদা বাথরুমের দাবি কিন্তু আইনসিদ্ধ। কিন্তু তবুও সেই বাথরুম ভারতের ক’টা সংস্থায় আছে, তা হাতে গুনে বলা যায়। পাবলিক টয়লেটে এখনও সেই সুযোগ পাওয়া যায়নি। ট্রান্স মানুষেরা দিনের পর দিন কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে রাস্তায় বাথরুমের সুযোগ পান না। মহিলাদের বাথরুম ব্যবহার করলে মহিলারা আপত্তি জানান, পুরুষদের বাথরুম ব্যবহার করলে পুরুষদের লালায়িত চোখ তাঁদের ধাওয়া করতে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে নারীবাদী আন্দোলন ও প্রান্তিক লিঙ্গ যৌনতার মানুষের অধিকার আন্দোলন ট্রান্স মানুষদের বাথরুমের অধিকার ও সুযোগ নিয়ে কথা বলে চলেছে। কিন্তু আজও সেই ন্যূনতমটুকু পাওয়া যায়নি।
আজ, মেয়ে ও প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার মানুষেরা যখন ধর্ষণের বিরুদ্ধে রাতভর মিছিলে জাগছেন, তাঁরাও প্রয়োজনমতো টয়লেট ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছেন কি? যে মেয়েটি একা পথে বেরিয়ে পড়তে চাইছে, স্টেশনে-হাইওয়েতে সে বাথরুমে যেতে পারবে তো? এবং, শারীরিক প্রয়োজন মিটিয়ে ধর্ষিতা না হয়ে ফিরে আসতে পারবে তো?
আজ, একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার পর যখন কিছু মানুষের টনক নড়েছে, তা সে যত যৎসামান্য নড়ে বসাই হোক, তখন এই প্রশ্নগুলো করে যেতে হবে মেয়ে ও প্রান্তিক লিঙ্গ যৌনতার মানুষদের। এমন সজোরে, সপাটে বলে যেতে হবে, যাতে রাষ্ট্র ও পিতৃতন্ত্রের মনে পড়ে যায়, যে-কোনো মানুষের মতোই তাদেরও শারীরবৃত্তীয় চাহিদা রয়েছে। তা প্রাকৃতিক। তা স্বাভাবিক।
প্রশ্ন জরুরি। কারণ প্রশ্নের ভিতরই অব্যবস্থার ছবিটুকু থাকে। ধর্ষণ, ধর্ষ সংস্কৃতি হোক বা ন্যূনতম টয়লেট, সবকিছু নিয়েই প্রশ্ন থাকুক।
প্রশ্নই সেই সিঁড়ি, যেখান থেকে অধিকার আদায়ের এক ধাপ অন্তত এগোনো সম্ভব।