শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদের ক্ষেত্রে অনশন চিরদিনই বড় অস্ত্র। সেই অস্ত্রই হাতে তুলে নিয়েছিলেন এক নারী। মানেননি দলনেতার নিষেধও। আসুন, শুনে নেওয়া যাক তাঁর কথা।
দেবীপক্ষে যে দুর্গার আবাহন, তিনি সমবেত প্রতিবাদেরই মূর্ত রূপ। যে নারীকে ধাত্রী বলে মনে করা হয়, সেই নারীই আবার প্রতিবাদে শক্তিরূপিণী। এ দেশের ধর্ম-সংস্কৃতি যেমন সে কথা জানে, তেমনই সে কথার সাক্ষ্য দেয় এ দেশের ইতিহাসও। কখনও অস্ত্র হাতে সংগ্রামে, কখনও শান্ত বিপ্লবে এ দেশের নারীরা বারেবারে সেই প্রতিবাদের ধারায় পা মিলিয়েছেন। তাঁদের মধ্যেই রয়েছেন এই নারী। তিনিই দেশের রাজনীতিতে প্রথম মহিলা কর্মী, যিনি রাজনৈতিক প্রতিবাদ জারি রাখতেই মাসাধিক কাল অনশন চালিয়ে গিয়েছিলেন।
দেশের স্বাধীনতার জন্য মরণপণ লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন যে বীরাঙ্গনারা, তাঁদের মধ্যে অন্যতম মৃণাল দেবী। যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বা বাঘা যতীনের মামাতো ভাই ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ের পর রাজনীতির বলয়ে এসে পড়েছিলেন তিনি। কংগ্রেসের বিভিন্ন অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন বহরমপুরের এই নারী। ক্রমে ক্রমে নিজেও হয়ে উঠেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন শরিক। আর সেই সম্পর্কের প্রতি বিশ্বস্ততাই তিনি প্রমাণ করে দিলেন বিপ্লবী যতীন দাসের মৃত্যুর পর।
১৯২৯ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর ৬৩ দিন অনশনের পর বিপ্লবী যতীন দাস মৃত্যুবরণ করেন। সারা দেশে এই ঘটনার ব্যাপক প্রভাব পড়ে। অস্থির হয়ে ওঠেন সুভাষচন্দ্র, বিচলিত হন রবীন্দ্রনাথ। এই মর্মান্তিক ঘটনার জেরে রাজনৈতিক কর্মীরা ফুঁসছিলেন প্রতিবাদ প্রকাশের জন্য। সেই অস্থিরতাকে শান্ত করার জন্য অনশন বা আত্মদানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন খোদ মহাত্মা গান্ধী। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে গ্রামে বাঁধা হল অনশন মঞ্চ। মঞ্চে অনশন শুরু করলেন মৃণাল দেবীও। ১৯২৯ এর ২৮শে সেপ্টেম্বর দৈনিক বঙ্গবাণী পত্রিকায় ‘অনশনব্রতে মহিলা’ শিরোনামে এ ঘটনা প্রকাশ পায়। কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের নিষেধাজ্ঞা মেনেই মৃণাল দেবীকে চিঠি লিখে অনশন প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্রও। যদিও সে অনুরোধ সবিনয়ে, কিন্তু দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন এই বীরাঙ্গনা।
শেষ পর্যন্ত ঠিক কত তারিখে তিনি অনশন ভঙ্গ করেছিলেন তা নির্দিষ্ট ভাবে জানা না গেলেও শোনা যায়, অনশন চলেছিল টানা ৩৯ দিন। সম্ভবত ভারতবর্ষে মৃণালদেবীই প্রথম মহিলা রাজনৈতিক কর্মী যিনি এত দীর্ঘদিন অনশন করেছিলেন। মৃণালদেবীর এই অনশন-সংবাদ পৌঁছে গিয়েছিল লাহোর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি ভগৎ সিংয়ের কাছেও। ১৯২৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় লাহোরে। সেই সময় মৃণাল দেবীর সঙ্গে দেখা হলে তাঁকে ওয়াটারম্যান কোম্পানির একটি কলম উপহার দিয়েছিলেন জেলবন্দি ভগৎ সিং। পরবর্তী কালে অনশনরত রাজবন্দিদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতেও সরব হয়েছিলেন এই নারী।
মৃণাল দেবীকে হয়তো আমরা সেভাবে চিনি না। তবে তাঁর রাজনৈতিক অস্ত্রটিকে কিন্তু আমরা ভুলিনি এখনও। একালের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ প্রয়োজনে অনশনের অস্ত্রে শান দিতে পারে, এখনও।