শরৎকাল জুড়ে পুজোর গল্প। গল্পের এই মরশুমে শুনুন সংবাদ প্রতিদিন শোনো-র নিবেদনে নতুন গল্প। আজকের গল্প, বিশ্বদীপ দে-র ‘উজানযাত্রা‘। পড়ে শোনাচ্ছেন, শঙ্খ বিশ্বাস। অলংকরণে সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়।
শুনুন গল্প: ‘উজানযাত্রা‘।
দেখেছিলাম বইটা শোয়ানো রয়েছে অনেক বইয়ের মাঝে। যেমন থাকে। মেঘলা বিকেলের মিহি আলো সেটার উপরে পড়েছিল। সবুজ রঙের মলাট। উপরে ক্যালিগ্রাফিতে লেখা ‘উজানযাত্রা’। নিচে লেখকের নাম। অনির্বাণ রায়। কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথ আমাকে অনেক ম্যাজিক দেখিয়েছে। কখনও জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতার হলদে হয়ে যাওয়া শেষ পাতায় তিনজোড়া লিপস্টিক মাখা ঠোঁটের খয়েরি চুমুর দাগ। কখনও ইনল্যান্ড লেটারে বোনকে লেখা দিদির গোপন স্বগতোক্তি। পুরনো বইয়ের দুনিয়া থেকে পাওয়া পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনার মতো এই সব কিছুই আমি গ্রহণ করেছি। লেখার মধ্যে মিশিয়ে নিয়েছি যাবতীয় চুম্বন ও কান্নার দাগ। কিন্তু আজ ওই বইটা যেভাবে আমাকে হতবাক করে দিল, তেমন ম্যাজিক… নাহ! এর আগে পথের ধারে শুয়ে থাকা এই সব সারি সারি বইয়ের কেউই কখনও দেখাতে পারেনি।
আমার পাশেই এক ভদ্রলোক একগাদা বই কিনছেন। সব ডাঁই করে রাখা। দরদস্তুর চলছে। এই অবস্থায় আলতো ইশারায় জানতে চেয়েছিলাম বইটার দাম। দোকানদার বোধহয় তৃতীয়বারে সাড়া দিল। অসংখ্য বইয়ের আড়াল থেকে সে হেলাফেলা ভঙ্গিতে পঞ্চাশ টাকা চাওয়া মাত্র আমি আর দেরি করিনি। অন্য সময় হলে তিরিশ বলতাম। কিন্তু আজ কোনও দরাদরি না করেই টাকা মিটিয়ে বইটা হাতে তুলে হাঁটা শুরু করলাম। কোনদিকে যাব বুঝতে পারছি না। অথচ আজ অনেকগুলো জায়গাতেই যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সব হিসেব গুলিয়ে দিচ্ছে বইটা। কেননা আমার নাম অনির্বাণ রায়। আর এই মুহূর্তে যে উপন্যাসটা লেখার কথা ভাবছি সেটার নাম ‘উজানযাত্রা’! এমনকি, লেখার সঙ্গে সঙ্গে এই বইয়ের প্রচ্ছদ যেমন হবে বলে কল্পনা করা শুরু করেছিলাম এই বইয়ের মলাটও অবিকল তেমনই। ক্যালিগ্রাফিতে ‘উ’-এর মাত্রা বা মলাটের সবুজ রং যেন অবিকল আমার মনের ভিতর থেকে উঠে আসা! বইটা খোলার সাহস হয়নি। ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে আমি কফি হাউসের দিকে হেঁটে গেলাম। যে উপন্যাস লিখতে চাই, সেটাই ফুটপাথে এসে শুয়ে রয়েছে! চারপাশে এক লাল-নীল রঙের সন্ধে। গাড়ির শব্দ, ভিড়, দোকানের সামনে ও ভিতরে ডাঁই করে রাখা বইয়ের স্তূপ… বই বই আর বই! এর মধ্যে কোন গোপন আততায়ী আমার না লেখা বইটা রেখে দিয়ে গেছে! আর অপেক্ষা করেছে বিস্ফোরণের! কাকে বলব এ কথা? কে বিশ্বাস করবে? বইটা হাতে নিলেও করবে না আমি জানি। বলবে, অনির্বাণ রায় কি একজনই আছে? কী করে বোঝাব, অনির্বাণ রায় নিশ্চয়ই অনেক আছে। কিন্তু উজানযাত্রা? সবুজ মলাট? ক্যালিগ্রাফির ওই ‘উ’?
কফি হাউসের সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে ভিতরে ঢুকেই দেখতে পেলাম অরুণদাকে। প্রতি শনিবার এই আড্ডা বসে সাহিত্যিক অরুণ সেনকে ঘিরে। সত্তরোর্ধ্ব অরুণদা নিজের খেয়ালে এই লেখককে ভালো বলেন। ওই লেখককে উড়িয়ে দেন। সব কিছুর পিছনেই কী সব ক্যালকুলেশন থাকে। খুব যে ভালো লাগে তা নয়। তবু অভ্যাসে অনেক সময় আমিও এসে পড়ি এই আড্ডায়। হঠাৎ মনে হল, অভ্যাস? নাকি অরুণদার মতো প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় থাকার লোভ? ভাবতেই কেমন ঘেন্না হল নিজের প্রতি। অরুণদার পাশে বসে আমার আর-এক লেখক বন্ধু অমিয়। ও দূর থেকে আমাকে দেখে হাত দেখাল। আমিও পালটা হাত তুললাম। তারপর আচমকাই কী যেন মনে পড়ে গেছে, এরকম ভঙ্গি করে বেরিয়ে এলাম। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই ঠিক করলাম আজ কারও সঙ্গে খোশগল্প করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
সন্ধে ফুরিয়ে যাওয়ার এই সব মুহূর্তে রাত নামে, চুপিচুপি একা একা। সাড়ে সাতটা বেজে গিয়েছে। বইয়ের দোকানগুলো বন্ধ হয়ে যাবে এবার। আমি আকাশের দিকে তাকালাম। অনেকটা উঁচুতে পাথুরে চাঁদ প্রলয়ের আগের মুহূর্তের মতো নিশ্চুপ। অন্যদিন আমি একবার আমার প্রকাশকের ঘরেও ঢুঁ মারি। আজ তাও অসম্ভব। ব্যাগ থেকে বইটা বের করলাম। এক গোপন সন্ত্রাসবাদীর ভঙ্গিতে। যেন এখনই বইটা বিস্ফোরণ ঘটাবে। আর গোটা কলেজ স্ট্রিট গুঁড়িয়ে যাবে এক মায়াময় বিষদাঁতের ঢেলে দেওয়া বারুদে। ভাবতে ভাবতেই মনে হল আমার এখন একটাই গন্তব্য হতে পারে। শ্রীগোপাল মল্লিক লেন। এই সরু গলির ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি বইটার গায়ে হাত বোলাতে লাগলাম। মনে পড়ছে, বহু বছর আগে কলেজে পড়ার সময় আমি আর দীপক প্রথমবার এসেছিলাম এখানে। এক প্রকাশকের দপ্তরে। তারপর প্রায়ই আমরা দুই বন্ধু ঢুঁ মারতাম এই গলিতে। কলেজ স্ট্রিটে এলেই। কত বিকেলকে এই গলির ভিতরে সন্ধের ভাঁজে ঢুকে যেতে দেখেছি। তেমনই একদিন। দীপকের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে এই গলি থেকে কীভাবে যেন অলিগলি ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছিলাম হাড়কাটা গলিতে। দীপকও বুঝতে পারেনি। আমিও না। যখন বুঝলাম চারপাশের ঘোর আমাদের ঘিরে ফেলেছে। নানা বয়সি মেয়ে, মহিলা, প্রৌঢ়া, তাদের কথা, আদিম আহ্বান এবং ক্যাডবেরির মতো গলন্ত কালচে এক সন্ধ্যার ভিতর দিয়ে হেঁটে এর পর কোথায় পৌঁছেছিলাম তা আজ আর মনে নেই। কিন্তু শ্রীগোপাল মল্লিক লেন বুঝিয়ে দিয়েছিল কোন গলির সঙ্গে কোন গলির পথ মিলে যাবে তা আমাদের জানার বাইরে। লেখার চৌহদ্দির মতোই তা এক নির্জনতাকে বুকে করে এগোতে গিয়েও আকস্মিক বাঙ্ময়তায় ফেটে পড়তে চাইবে সব সময়।
আজও কলকাতার এই প্রাচীন গলির ভিতরে ঢুকে পড়ে আমি যেন তাল রাখতে পারছি না। যে বই লেখা হয়নি, কেবল আমার মনের ভিতরে যার পাতা ফড়ফড় করে উড়ে চলেছে, তা কী করে পুরনো বইয়ের ভিতরে শুয়ে থাকতে পারে? পুরনো বই অবশ্য এমন ম্যাজিক পারে। বোর্হেসের ‘বুক অফ স্যান্ড’ যেমন এক এমন বইয়ের কথা বলে যার শুরু বা শেষ বলে কিচ্ছু নেই। দুই মলাটের ভিতরে অনন্ত পাতা, সেগুলিও ক্রম বদলায়। যা এখন দেখা যাচ্ছে, পরের বার বই খুললে আর সেটা পাওয়া যায় না। সেই বালির বইয়ের আত্মাও কি বালির? যে কেবল ঝুরঝুর করে ঝরে গিয়ে আবার অন্যভাবে গড়ে ওঠে! বোর্হেস সাহেব, আপনি তো বালির বইয়ের সন্ধান পেয়েছিলেন। কিন্তু এমন বই কি কখনও দেখেছিলেন, যা লেখক লেখার আগেই পৃথিবীর আলোহাওয়া মেখে চুপচাপ শুয়ে থাকে ব্যস্ত সড়কের একপ্রান্তে! তাকে ঘিরে বিকেলের আনমনা আলোর সারাৎসার নানা রঙের বুদবুদ তৈরি করতে থাকে।
বইটা খুলে দেখার লোভ হচ্ছে। বুড়ো আঙুল ও তর্জনীর সাহায্যে পাতা উলটে দেখতে গিয়ে টের পেলাম আমার হাত যেন কেউ আঁকড়ে ধরছে। কবজি জুড়ে এক অবাধ্য অসাড়তা! এক অলৌকিক, রহস্যময় যাত্রায় বেরিয়ে পড়েছি। সেই উজানযাত্রার কথাই তো লিখব ভেবে এসেছি চিরকাল। আমার সব লেখার নামই আসলে তাই। উজানযাত্রা।
একদিন শ্রীগোপাল মল্লিক লেন থেকে বাঁক নিতে নিতে হাড়কাটা গলিতে এসে পড়েছিলাম। কিন্তু আজ যে গলিতে এসে পড়েছি সেটা অবিকল আমাদের বাড়ির গলি! অন্যদিন হলে আমি নিজেকে উন্মাদ মনে করতাম। কিন্তু আজ এই না লেখা উপন্যাস ব্যাগে ঢুকিয়ে আমি অত্যন্ত ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম গলি দিয়ে। রাত তো খুব বেশি হওয়ার কথা নয়। তবু মনে হল, যেন বেশ রাত। পকেটে থাকা মোবাইল ফোনটায় সময় দেখা যায়। কিন্তু এখন নিজেকে সময়ের গোলকধাঁধা থেকে বিযুক্ত রাখাটাই বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। এই শরতেও কেমন এক কুয়াশার ঘোর আমাকে ঘিরে রাখছে।
বাড়িতে কেউ নেই। বউ গিয়েছে মাসির বাড়ি। সঙ্গে ছেলেকেও নিয়ে গিয়েছে। আজ ফেরার কথা নয়। তবু আমি গলিতে দাঁড়িয়েই দেখতে পেলাম দোতলায় আলো জ্বলছে! যেন একটা না খোলা চিঠি দুআঙুলের ভাঁজে ধরে আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠছি। চিঠির ভিতরে না বলা কার কথা যেন থরথরিয়ে কেঁপে চলেছে নাগাড়ে! ল্যান্ডিংয়ে সযত্নে খুলে রাখা আমারই স্যান্ডেল! কে বসে আছে আমার ঘরে? যন্ত্রচালিতের মতো ঘরে ঢুকে দেখতে পেলাম টিউবের আলোয় ঘর ভেসে যাচ্ছে। কম্পিউটারটা খোলা। নোটপ্যাডের সাদা পাতাটা আমারই অপেক্ষায়। চেয়ারে… নাহ… কেউ নেই। কিন্তু আমি জানি, ছিল। একটু আগেই। এখন সরে গিয়েছে কোনও অনির্দেশ্য আবছা কোণে। তার উপস্থিতির আঁচ এখনও লেগে আছে ইতিউতি। টেবিলের উপরে ‘উজানযাত্রা’ রেখে আমি কম্পিউটারের সামনে গিয়ে বসলাম। নোটপ্যাডের সাদা পাতায় বরফের প্রান্তর জেগে আছে।
টের পেলাম চারপাশে অসংখ্য প্রজাপতি উড়ছে। সেই কবে পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম ছোট ছোট হলদে প্রজাপতি বেরিয়ে আসছে পাথরের ভাঁজের ভিতরের কোন আশ্চর্য জগৎ থেকে। মোবাইলে ছবি তোলার চেষ্টা করে দেখেছিলাম কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কেবল খালি চোখে অনুভবের কোমল ইশারায় সেই প্রজাপতিরা নেচে চলেছে আমারই চারপাশে। নির্জন সেই পাহাড়ের মতোই এই ঘরের ভিতরে এখন অবিকল তেমনই আশ্চর্য সব প্রজাপতিদের অনুভব করতে পারছি। নির্বাক অথচ রিনরিনে এক সুরের ভিতরে বসে কিবোর্ডে আঙুল ছোঁয়াতে গিয়ে দেখলাম কে যেন সিলিং ফ্যানের তলায় মেলে ধরেছে ‘উজানযাত্রা’কে। ফড়ফড়িয়ে উড়ে চলা পাতার অন্দর থেকে খুদে খুদে কালো অক্ষরেরা উঁকি দিচ্ছে। যাদের আমি পড়তে চাইলেও পড়তে পারব না। কেবল স্বপ্নে পাওয়া সেই সব অক্ষরকে সাজিয়ে রাখতে পারব সাদা, শূন্য, অনন্ত এক পাতার গভীরে।