শরৎকাল জুড়ে পুজোর গল্প। গল্পের এই মরশুমে শুনুন সংবাদ প্রতিদিন শোনো-র নিবেদনে নতুন গল্প। আজকের গল্প, সৌরভ হোসেন-এর ‘কোল‘। পড়ে শোনাচ্ছেন, পড়ে শোনাচ্ছেন, শঙ্খ বিশ্বাস, চৈতালী বক্সী। অলংকরণে শান্তনু দে।
শুনুন গল্প: ‘কোল‘।
১
হাশরের মাঠে পাপ-পুণ্যের বিচার হচ্ছে। ‘মিজান’-এর পাল্লায় মাপা হচ্ছে পাপ-পুণ্য। একে একে মানুষ যাচ্ছে, আর তার আমলনামায় নথিবদ্ধ পাপ-পুণ্য নিয়ে ‘মিজান’-এর পাল্লায় চাপানো হচ্ছে। যার পুণ্যের পাল্লা ভারী হচ্ছে তাকে বেহেস্তে পাঠানো হচ্ছে, আর যার পাপের পাল্লা ভারী হচ্ছে তাকে নিক্ষেপ করা হচ্ছে দোজখে!
আজম এগিয়ে গেল। আজমের ভয় হচ্ছে। তার আমলনামায় তো সেরকম আল্লাহ-রসুলের কোনও ইবাদত নেই। সে কি পাপ-পুণ্যের বিচারে পাশ করবে? ঘামল আজম। কপাল চুকচুক করছে। আজমের সিরিয়াল এল। তার সামনে তার আমলনামা খোলা হল। মুখ নিচু করে আছে আজম। বুক দুরুদুরু করছে। তারপর একে একে ‘মিজান’-এর পাল্লায় চাপানো হতে লাগল পাপ আর পুণ্য। আজম বিস্মিত হয়ে দেখল, তার পুণ্যের পাল্লা অনেক ভারী! মহান ঈশ্বর বললেন, ‘তুমি পাশ করে গেছ আজম।’
আজম অবাক হয়ে ইশ্বরকে জিজ্ঞেস করল, ‘হে খোদা, আমি তোমার আর তোমার রসুলের সেরকম কিছুই ইবাদত করতে পারিনি। তবুও কী করে আমার পুণ্য বেশি হল?’
ঈশ্বর হাসলেন। তারপর আজমের চোখের সম্মুখে তার আমলনামার পাতা উলটাতে লাগলেন মহান ঈশ্বর। আজম চোখ বড় বড় করে দেখল, প্রতিটি পাতায় শুধু ছবি! যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের ভিতর পড়ে থাকা তার মায়ের কোলের ছবি! আর তখনই আজমের মনে পড়ে গেল গাজা ভূখণ্ডের সেই ছোট্ট বাড়িটার কথা।
২
আজম যখন জন্মেছিল, তখন রাত কেবলই উটের খুরে করে উপত্যকায় আসছিল। তার কিছুক্ষণ আগেই ফাল্গুনের হলুদ রোদ ভূমধ্যসাগরের জলে ঠিকরে পড়েছিল। সে রোদের রঙে লালাভ-হলুদ হয়ে উঠেছিল ভূমধ্যসাগরের জল। উটের কুঁজে করে নৈঃশব্দ্য নামতেই আকাশে উঠেছিল পূর্ণিমার চাঁদ। সে চাঁদের আলোয় জ্বলজ্বল করছিল কৃষ্ণচূড়া ফুল। সেই বসন্তের জ্যোৎস্নামাখা সন্ধ্যায় আজমের মা ইসমেতারার প্রসবযন্ত্রণা উঠেছিল। ঘরে বিদ্যুৎ আসেনি। টিমটিম করে জ্বলছিল কুপির আলো। মায়ের পেট থেকে বেরিয়েই জীবনের প্রথম কান্নাটা কেঁদেছিল আজম। তারপর সদ্যোজাত ছোট্ট চোখগুলো দিয়ে পিটপিট করে তাকিয়েছিল কুপিটার দিকে। সে দৃশ্য দেখে মা ইসমেতারার প্রসবযন্ত্রণা হারিয়ে গেছিল। আনন্দে তাঁর মুখখানা খিলখিল করে উঠেছিল। ভেবেছিলেন, এই ছেলে একদিন এই অন্ধকার দেশে আলো নিয়ে আসবে।
মাটির দেওয়াল। উপরে টিনের চালা। উপত্যকাটা গাজা ভূখণ্ডের নিচু শহর থেকে মাইল পাঁচেক দূরে। এখান থেকে সিনাই মরুভূমি দেখা যায়। কিছুটা দূরেই রাফাহ ক্রসিং। রাফাহ ক্রসিং হল মিশর আর গাজা ভূখণ্ডের মধ্যে একমাত্র সীমান্ত পারাপারের পথ। পূর্ব দিক জুড়ে রয়েছে ইজরায়েল রাষ্ট্র। ধ্বংসের দৃশ্য আজ নতুন নয় আজমের কাছে। যখন তার এক বছর বয়স তখন ইজরায়েলি বোমা বর্ষণে তাদের মাটির বাড়িটা ধুলো হয়ে গেছিল। সে বয়সের কথা আজমের মনে নেই। কিন্তু পাঁচ বছর বয়সের ধ্বংসস্তূপের কথাটা তার মনে আছে। সেবারও ইজরায়েলি সেনা তাদের উপত্যকায় বোমা বর্ষণ করেছিল। গোটা উপত্যকা একটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর বসে একটি ভাঙা ইটের টুকরো দিয়ে ভাঙা দেওয়ালের গায়ে জীবনের প্রথম ছবিটা এঁকেছিল আজম। সেই শুরু, আর তুলি থামেনি আজমের। আজম বলে, যুদ্ধই তাকে শিল্পী বানিয়েছে।
সেদিনও আজম শুনেছিল, ইজরায়েলি সেনার আক্রমণে গাজার এই ভূখণ্ড পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে গেছে। কোনও প্রাণের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই। আজমের বুকটা ফুঁপিয়ে উঠছিল। ছলছল করছিল চোখ। গাড়িটা যত এগিয়ে যাচ্ছিল ততই রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে আসছিল। ধ্বংসস্তূপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে রাস্তার ওপর। রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। রাস্তার দুপাশে যে সমস্ত খেজুর গাছগুলো দাঁড়িয়ে ছিল তাদেরও ডালপালা ভাঙা। মোচড়ানো। পোড়া। আজমের আশা, এই ধ্বংসস্তূপে একজনও যদি বেঁচে থাকেন, তিনি তার মা ইসমেতারা। কত ধ্বংসস্তূপ থেকে বের হয়ে এসেছেন তার মা! কত বোমার আঘাত থেকে বেঁচে ফিরেছেন! মিসাইল হানাটা ঘটেছিল গত রাতে। তখন এশার ওয়াক্ত চলছিল। তবে কি মা যখন নামাজে বসেছিলেন তখনই হানাটা ঘটেছে? মা ইসমেতারাকে কোনও দিন নামাজ কামাই করতে দেখেনি আজম। বাবা শহিদ হওয়ার পর মায়ের এই ঈশ্বরপ্রীতি আরও বেড়ে গেছে। আজমকে বলেন, ‘শুধু রং-তুলিতে মজে থাকলে পরকালে মুক্তি পাবিনে বেটা, আল্লাহ-রসুলে মজতে হবে।’
আজম তখন মাকে বলে, ‘ইহকালের মুক্তি আগে পাই, তারপরে পরকালের মুক্তির কথা ভাবব।’
আজম ইজরায়েলের আক্রমণের হাত থেকে ফিলিস্তিনিদের মুক্তির কথা বলত। মা ইসমেতারা তখন ছেলে আজমকে বলতেন, ‘সেজন্য তো অস্ত্রের প্রয়োজন বেটা, ছবি কী হবে?’ আজম তখন মা ইসমেতারার ফর্সা মুখে একটা চুমু দিত। আর বলত, ‘এর চেয়ে কি দুনিয়ায় বড় অস্ত্র আছে মা?’ ইসমেতারা তখন ছেলের কীর্তি দেখে হাসতেন। মায়ের সে হাসিমুখখানাই আজমের কাছে এই দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর ছবি। সে ছবি বহুবার এঁকেছে আজম। আজম বলেছে, ‘এই সুন্দর মুখখানাই আমার প্রিয় প্যালেস্তাইন।’
ধ্বংসস্তূপ ঠেলে রেড-ক্রসের গাড়িটা এগোচ্ছিল সীমান্তের দিকে। একটা স্থানে এসে গাড়িটা থেমেছিল। রাস্তা বন্ধ। ধ্বংসস্তূপ পাহাড় হয়ে ছিল। গাড়ি থেকে নেমেছিল আজম। হেঁটে গেছিল ধ্বংসস্তূপের ওপর দিয়ে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মৃতদেহ দেখে তার ভিতর কেঁদে উঠছিল। মুখের সব ভাষা কষ্টে বদলে যাচ্ছিল। যেন পেট আর বুকের ভিতর শুধু দলা পাকিয়ে ছিল কষ্ট। কোনও হাড়গোড়, অস্থি-তরুণাস্থি নেই! প্রথমে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে নিজেদের বাড়িটা চিনতেই পারেনি আজম। আজম পাগলের মতো সরাচ্ছিল ধ্বংসস্তূপ। অবশেষে একটি ভাঙা দেওয়ালের গায়ে তার আঁকা ক্যালিগ্রাফি দেখে নিজেদের বাড়িটা চিনতে পেরেছিল আজম। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দেওয়ালটাকে সরিয়েছিল। তারপর ভিতরে ঢুকতেই আজম দেখেছিল, তার মা মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন। মৃত ইসমেতারার মাথা গলা অবধি ধ্বংসস্তূপে ঢেকে ছিল। আর নিচে কোমর অবধি ঢেকে ছিল ধ্বংসস্তূপে। দেখা যাচ্ছিল শুধু কোলখানা! এই কোলেই বড় হয়েছিল আজম।
আজম মা ইসমেতারাকে বলত, ‘এই কোলই আমার বেহেস্ত। আমার আর কোনও বেহেস্তের দরকার নেই।’
তখন ইসমেতারা বলতেন, ‘দেশ থাকলেই তো কোল থাকবে! দেশটাই তো থাকছে না।’
আজম তখন বলত, ‘কোল থাকলেই দেশ থাকবে মা।’
তারপর থেকে আজম একটাই ছবি আঁকত। যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে পড়ে থাকা এক নারীর ‘কোল’-এর ছবি! যে নারীর গলা থেকে মাথা আর পা থেকে কোমর ধ্বংসস্তূপে ঢেকে আছে, আর দেখা যাচ্ছে শুধু কোল! আজম রাত-দিন এই কোলের ছবিই আঁকত! নানান ঢংয়ে। নানান মাধ্যমে। তখন আজমের মাথার চুল ধানের শিকড়ের মতো ঝোপ। মুখের দাড়ি উশকোখুশকো। টানা চোখগুলোও কেমন ঘুলঘুলে। শরীরে যত্ন-আত্তি নেই। পেটেও ঠিকভাবে দানাপানি পড়ে না। শরীরখানাকে দেখে মনে হত, একখানা খড়িতে কিছু হাড় জোড় দেওয়া আছে! মনে হত, নিজের শরীর থেকে মাংস খুলে খুলে ক্যানভাসের ছবিতে লাগায় আজম! অথচ এই একখানা ‘কোল’-এর ছবিই তাকে বিশ্বখ্যাতি এনে দিয়েছিল। বিশ্বজুড়ে তৈরি করেছিল বিশাল জনমত। যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। প্যালেস্তাইনের উপর ইজরায়েলি হানা বন্ধ করতে হবে। সারা বিশ্বকে ‘স্বাধীন প্যালেস্তাইন’-এর স্বীকৃতি দিতে হবে।
আসলে আজম তখন একজন মানসিক রুগি। যেদিন প্রথম ক্যানভাসে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকা তার মায়ের ‘কোল’-এর ছবিটা এঁকেছিল, সেদিন থেকেই আজম পাগল হয়ে গেছিল। অথচ বিশ্বের মানুষ এ সত্যটা জানত না। তারা ভাবত, বড় মাপের শিল্পী এমনই হন। আজম যে ঘরটায় থাকত, সে ঘরের সমস্ত দেওয়ালে মায়ের ‘কোল’-এর ছবি ছিল! সমস্ত আসবাবে ‘কোল’-এর ছবি! এমনকি পোশাকআশাকেও সেই একই ছবি!
সেদিনও আজম তুলি হাতে নিয়েছিল। যুদ্ধের আওয়াজ শুনলেই আজমের ছবি আঁকার নেশা উঠত। ক্যানভাস ছুঁল তুলি। বাইরে তখন ইজরায়েলি বোমারু বিমান থেকে বোম পড়ার শব্দ ভেসে আসছিল। আর ভেসে আসছিল মানুষের চিৎকার। কান্নার ধ্বনি। আজম আপশোশ করত, এ কান্নার শব্দ না শুনতে পান কোনও পয়গম্বর না ঈশ্বর! অথচ এই মাটিতেই কত পয়গম্বরের জন্ম হয়েছিল! আজম যেই তুলিতে টান দিয়েছিল, অমনি দক্ষিণ গাজার এই ছোট্ট ঘরটাতেই পড়েছিল ইজরায়েলি সেনাদের ছোড়া মিসাইল। ক্যানভাসের ছবির মতো ছবি হয়ে গেছিল আজম।
৩
কিন্তু ওটা কীসের মানচিত্র! আমলনামায় একটি দেশের মানচিত্র দেখে ভ্রূ টান হয়ে গেল আজমের।
আজম ঈশ্বরকে জিজ্ঞেস করল, “ওটা কীসের মানচিত্র, খোদা?”
মহান ঈশ্বর বললেন, “তুমি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় পুণ্যের ইবাদত করেছ, আজম। তোমার ‘কোল’-এর ছবির জন্যই ফিলিস্তিনিরা একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছে। এটা স্বাধীন প্যালেস্তাইন দেশের ছবি।”
তারপর মহান ঈশ্বর আজমকে হুকুম করলেন, “তুমি বেহেস্তে যাও।”
আজম বেহেস্তে গেল। কিন্তু সেখানেও তার জন্য বিস্ময় অপেক্ষা করছিল! তার জন্য বরাদ্দ বেহেস্ত দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল আজমের। এ কেমন বেহেস্ত! এরকম বেহেস্তের কথা তো কখনও শুনিনি! এ তো আমার মায়ের সেই ‘কোল’-এর ছবি!