বঙ্গ মাতৃআরাধনার দেশ। এ দেশে মঙ্গলকাব্য রচিত হয় দেবীদের উপজীব্য করে। বঙ্গের অধিষ্ঠাত্রী বলে মনে করা হয় দেবী কালীকে। বাংলার স্থানে স্থানে মন্দিরে মন্দিরে পূজা পান তিনি। তবে দেবীর আরেক রূপ, মহামায়া দুর্গার আরাধনা কি কেবল পূজামণ্ডপের চারদিনেই সীমাবদ্ধ? নাকি বাংলায় দেখা মেলে দুর্গা মন্দিরেরও? জানালেন সৌভিক রায়।
বলা হয়, “কালিকা বঙ্গদেশে চ অযোধ্যায়াং মহেশ্বরী | বারাণস্যামন্নপূর্ণা গয়াক্ষেত্রে গয়েশ্বরী।।”
অর্থাৎ দেবী কালী হলেন বঙ্গের অধিষ্ঠাত্রী। বাংলার দিকে দিকে কালকে ধারণকারী কালীর মন্দির রয়েছে। কিন্তু মায়ের আরেক রূপ যে মহামায়া দুর্গা, তাঁর ক্ষেত্রেও কি একই কথা বলা চলে?
রাজবাড়িতে, জমিদারবাড়ির ঠাকুরদালানে শুরু হয়েছিল দুর্গার আরাধনা। তবে বৈভব প্রদর্শন ছিল আদত উদ্দেশ্য। আঠারো শতকের একেবারে শেষলগ্নে, জমিদারবাড়ির উঠোন ছেড়ে দেবী নেমে এলেন সাধারণের আঙিনায়, হয়ে উঠলেন সর্বজনীন। কেবল চারটে দিনের আরাধনার মণ্ডপ নয়, গোটা বাংলায় ছড়িয়ে রয়েছে দেবী দুর্গার অসংখ্য মন্দির। দেবালয়গুলিতে যুগ যুগ ধরে পূজিতা হচ্ছেন দশভূজা। পুরুলিয়ার দেউলঘাটায় রয়েছে প্রায় দুহাজার বছরের পুরনো দুর্গা মন্দির। সম্ভবত এটিই বাংলার প্রাচীনতম দুর্গা মন্দির।
এসে পড়ে চিত্তেশ্বরী মন্দিরের কথা। চিত্তেশ্বরী, বাংলার একমাত্র ডাকাতের আরাধ্যা দুর্গা। প্রচলিত এক জনশ্রুতি অনুযায়ী, চিতে ডাকাতের নাম থেকে দেবীর নাম চিত্তেশ্বরী হয়েছে। দেবীর নামেই চিৎপুরের নামকরণ হয়েছে। মন্দিরের দুর্গা বিগ্রহ নিমকাঠ নির্মিত। ১৬১০ সালে এ মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল মনোহর ঘোষের হাতে।
কুমারটুলিতে রয়েছেন ঢাকেশ্বরী। ঢাকার দেবী বিমানে চেপে এখানে এসেছেন দেশভাগের সময়। অষ্টধাতু নির্মিত এই মূর্তির বয়স আটশোর বেশি বলেই জানা যায়। দেবী দশভুজা, তবে আটটি হাত খালি। ১৮৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দয়াময়ী দুর্গা মন্দির। সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল জিতু ঘোষালের হাত ধরে। দেবী এখানে প্রস্তর মূর্তিতে বিরাজমানা। বাঁকুড়ার কাটনার দুর্গা মন্দিরেও সপরিবার পাথরের দুর্গাপ্রতিমা প্রতিষ্ঠিত।
ভূ-কৈলাসে আছেন পতিতপাবনী। ১৭৮২ সালে রাজা জয়নারায়ণ ঘোষাল পতিতপাবনী দুর্গার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। খিদিরপুর ট্রাম ডিপোর কাছে ভূ-কৈলাস রাজবাড়ির মধ্যেই রয়েছে এই মন্দির। বেহালার ব্রাহ্ম সমাজ রোডের মুখার্জী বাড়িতে সোনার দুর্গা মন্দির রয়েছে।
ঝাড়গ্রামে রয়েছে পাঁচশো বছরের পুরনো কনক দুর্গা মন্দির, ডুলুং নদীর তীরে অশ্বারোহিনী চতুর্ভূজা দেবী পূজিতা হন। বীরভূমের মুরারইয়ের মহুরাপুরের মধ্যে রয়েছে ভদ্রকালী মন্দির। মন্দিরে রয়েছে তিন ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট অষ্টভুজা মহিষমর্দিনীর মূর্তি। মূর্তির বয়স হাজারেরও বেশি। পাথর খোদাই করে মূর্তি গড়া হয়েছিল। নামে কালী মন্দির হলেও এখানকার দেবী দুর্গা। দুর্গাপুজোর নবমী তিথিতে পূজিতা হন দেবী। এখানে অন্ন ভোগ হয় না, দেবীকে ফল, চিঁড়ে দেওয়া হয়। কর্ণাটকের রাজা বিক্রমাদিত্যের বঙ্গ অভিযানের পর তাঁর সেনাবাহিনীর অনেকেই বাংলায় থেকে গিয়েছিল। তাঁর সেনাপতি বিশ্বসেন থেকে গেলেন রাঢ়বঙ্গে। বিশ্বসেনের দৌহিত্র হেমন্ত বর্ধমানে স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। এই বংশের উত্তরপুরুষ ভদ্রসেন, ভদ্রকালী মন্দির ও মূর্তি নির্মাণ করান।
হুগলির কোন্নগরের কালীমাতা আনন্দ আশ্রমের অষ্টাদশভুজা দেবী দুর্গার পুজো হয়। এই পুজো শতবর্ষ পার করে ফেলেছে। জনশ্রুতি অনুযায়ী, এই অঞ্চলের সাধুর ঘাট এলাকায় শ্মশান ছিল। শ্মশানেই থাকতেন সাধক সূর্যনারায়ণ সরস্বতী। তিনিই কালীমাতা আনন্দ আশ্রম গড়েন। দেবী অষ্টাদশভুজার আরাধনার সূচনাও তাঁর হাতেই। দেবীর আরাধনা হয় তন্ত্রমতে। অষ্টাদশভুজা দেবীর মুখমণ্ডল শ্বেতবর্ণের, হাত হয় নীল বর্ণের, দুই পা রক্তবর্ণ। এ ছাড়াও তারাপীঠ মন্দিরের মা তারাকে, সর্বমঙ্গলা মন্দিরের সর্বমঙ্গলা দেবীকে দুর্গাপুজোর সময় দুর্গা রূপে পুজো করা হয়। তারকেশ্বর মন্দিরের গর্ভগৃহে থাকা দুর্গাপটকে পুজো করা হয় দেবীপক্ষে।
বঙ্গ মাতৃআরাধনার দেশ। এ দেশে মঙ্গলকাব্য রচিত হয় দেবীদের উপজীব্য করে। রাঢ় বাংলা তথা তাবত বাংলায় সুদীর্ঘ কাল জুড়ে কুলদেবী রূপে সিংহবাহিনী দেবীর পুজো হত। পুজো পেতেন অন্নপূর্ণা, বিন্ধ্যবাসিনী, রাজরাজেশ্বরীর মতো দেবীরা। তাঁরা সকলেই মহামায়া, শক্তির মাতৃরূপের প্রকাশ। তাই বঙ্গ যতটা কালীর, ততটাই দুর্গারও, এ কথা বললে অত্যুক্তি হয় না আদৌ।