অলংকরণে দীপঙ্কর ভৌমিক
রাত পোহালেই ষষ্ঠী। হাতে সময় নেই বললেই চলে। এর মধ্যে সাজ শেষ করতে হবে। তার আগে ঢুকে যেতে হবে মণ্ডপে। আগে বাহনগুলোকে ঠিকমতো দাঁড় করাতে হবে। তারপর গণেশ, কার্তিক। লক্ষ্মী-সরস্বতীকে নিয়ে চিন্তা নেই। তাও… এমনই হাজার চিন্তা ভিড় করেছে দেবী দুর্গার মাথায়। ইতিমধ্যেই সূয্যি ডুবল পাটে। পাঁচ বাহন, চার সন্তান আর অসুরকে সঙ্গে নিয়ে পথে নামলেন দুর্গা। গত বছরের জ্যামের কথা বেশ মনে আছে। এবার আর দেরি করলে চলবে না।
আপাতত গন্তব্য ধর্মতলা। বাসে একটু তাড়াতাড়ি হত, কিন্তু জ্যাম ঠেলে তার চাকা গড়াবে, তবে তো! তার ওপর যা ভিড়। ছোট্ট বাসে দশখানা হাত, এতগুলো ছানা আর বাহন নিয়ে উঠলে আবার না বাড়তি ভাড়া চায়! কাজেই ভরসা থাকুক ট্রামে। তাতে চড়েই দেবী যাবেন মণ্ডপে। কৈলাস থেকে রওনা দেওয়ার আগেই ঠিক করে ফেলেছিলেন। মহাদেবও শুনে আপত্তি করেননি। করেই বা কী লাভ, আরও একবার দশ দিকে দশ মহাবিদ্যার দর্শন পাওয়ার সাধ নেই তাঁর। সুতরাং প্ল্যানমাফিকই দুর্গা অ্যান্ড ফ্যামিলি এসে পড়লেন বড় রাস্তায়। এখানেই ট্রামলাইন। সোজা যাচ্ছে ধর্মতলা। ট্রামে না উঠলেও গল্প শুনেছেন দেবী।
এই তো কয়েক বছর আগের কথা। বাগবাজারে অষ্টমীর সন্ধে। সেবার সন্ধিপুজো পড়েছিল দুপুরবেলা। সন্ধ্যায় আর পুজোর ঝক্কি নেই। মণ্ডপের ভিড়ে শুধুই কপোত-কপোতী। তার মাঝে দুজন কী নিয়ে ভয়ানক ঝগড়া চালিয়ে যাচ্ছে। কান পেতে শোনার চেষ্টা করলেন দুর্গা। বোঝা গেল, ঝগড়ার বিষয় ট্রাম। একজনের দাবি ট্রামে চড়ে বাড়ি ফিরবে, অন্যজন সময়ের অজুহাত দিয়ে বাস বা ক্যাবের কথা বলছে। প্রথমজন সময় নিয়ে ভাবতে রাজি নয়, তার কাছে পরিবেশবান্ধব ট্রামে চড়াই শহর বাঁচানোর একমাত্র উপায়। ফিরতে নাহয় দেরিই হবে খানিক, কিন্তু তাতে প্রিয়জনের সঙ্গে আরও খানিক সময় কাটানোর সুযোগ মিলবে, সঙ্গে পুরনো দিনে ফিরে যাওয়ার নস্টালজিয়া। সেদিন শেষমেশ জিতেছিল ট্রামই। আর তাদের কথায় কথায় শহর কলকাতার সেই নস্টালজিয়ার আঁচ পেয়েছিলেন দুর্গাও। সঙ্গে এও বুঝেছিলেন, পরিবেশবান্ধব বলেই এ যান কেবল অতীতের নয়, ভবিষ্যতেরও।
আসলে মর্তের লোকজন যে হারে পরিবেশের ক্ষতি করছে, তাতে স্বর্গকেও তা নিয়ে মাথা ঘামাতে হচ্ছে বইকি! রাস্তায় যত না মানুষ, তত গাড়ি, আর তার ধোঁয়ায় গোটা আকাশখানা কালো। সে ধোঁয়া মানুষের আয়ুও যে গিলে নিচ্ছে, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন যমরাজ। সুতরাং পৃথিবীর পরিবেশ বাঁচানোর জন্য আজকাল মাঝে মাঝেই ঠাকুর-দেবতারাও মিটিংয়ে বসছেন। সেবার ফিরে গিয়ে এমনই এক বৈঠকে দুর্গা কড়া নির্দেশ দিয়েছিলেন, এবার থেকে ট্রামে চড়ে মণ্ডপে যাওয়া মাস্ট। তবে দেখছেন, বিশ্বকর্মা ছাড়া সে নির্দেশ কেউই তেমন মানেননি। আরে বাবা, এখনকার দিনে বিজ্ঞাপন আর বিজ্ঞাপনের মুখটাই হল গিয়ে আসল কথা! দেবদেবীরা যদি ব্র্যান্ডিং না করেন, তবে মর্তের বেয়াক্কেলে লোকগুলো দেরির দোহাই দিয়েই ট্রামে লালবাতি জ্বেলে দেবে! হুঁঃ, গন্তব্যে যাওয়ার তাড়া দ্যাখো, যেন দেরি হলেই অলিম্পিকের মেডেলটা হাতছাড়া হয়ে যাবে!
গজগজ করতে করতে ঘড়ি দেখছিলেন দুর্গা। এই লোকগুলোর দৌলতে ট্রাম বোধহয় অদৃশ্যই হয়ে গেল। না হলে এই এক ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, বাস-ট্যাক্সি-ক্যাব সবই যাচ্ছে, অথচ একটা ট্রামের দেখা নেই! হঠাৎ ইঁদুরের চিৎকার! রাস্তার দিকে আঙুল উঁচিয়ে নেংটি বলছে, “ওই দেখো, পাজি অসুরটা ট্রামলাইন তুলে দিচ্ছে”…
মানেটা কী! রে রে করে তেড়ে গেলেন দেবী। গদা বাগিয়ে, ত্রিশূল উঁচিয়ে ব্যাটাকে দিলেন এক জোরসে খোঁচা! তা সাহস দ্যাখো, বেজায় বিরক্ত হয়ে অসুর মুন্ডু ঘুরিয়ে বলল, ‘বিরক্ত করবেন না তো! কাজ করছি।’ দুর্গা তো বেজায় অবাক। ব্যাটা বলে কী! পুজোর ছুটিতে মর্তে এসে কাজ? তাক বুঝে আউটসোর্সিং করছে নাকি! জানতে চাইলেন দেবী। উত্তর এল, বিশেষ কারও নির্দেশে ট্রামলাইন তুলছে অসুর। কিন্তু কে সেই নির্দেশ দিয়েছে, তার নামটা ব্যাটার পেট থেকে বের করা গেল না কিছুতেই। তবে এই কাজের জন্য মোটা টাকা মিলবে, বেশ ঠেস দিয়ে মা দুর্গাকে শুনিয়ে দিল অসুর। অবস্থা দ্যাখো, ছুটির মধ্যেও মাইনে বাড়ানোর ধান্দা! রাগটা গিলে নিয়ে দেবী মোলায়েম গলায় জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ রে, আমার যাওয়া বন্ধ করতেই এখানে ট্রামলাইন গুটিয়ে দিলি? অসুর মাছি তাড়ানোর মতো জবাব দিল, আপনার জন্য বন্ধ হবে কেন! একাধিক রুটেই বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে তো। বিজ্ঞ পণ্ডিতের মতো দুর্গাকে ট্রামের ইতিহাস বোঝাতে শুরু করল অসুর। এর আগে নাকি শহরের আরও অনেক জায়গায় ট্রাম চলত। হাওড়া ব্রিজের উপর দিয়েও। একে একে সেসব বন্ধ হয়েছে। যে কয়েকটা চলে, সেগুলোও এবার বন্ধের খাতায়।
চিন্তায় পড়ে গেলেন দেবী। আশঙ্কাটাই সত্যি হল তবে? ট্রামের ছুটির ঘণ্টা বেজেই গেল? প্যাকিং আর মর্তে আসার তাড়ায় দুদিন খবরের কাগজ পড়া হয়নি। তাড়াতাড়ি সরস্বতীকে জিজ্ঞেস করলেন, ট্রামের বিষয়ে নতুন খবর কিছু আছে কি না। ট্রামে উঠে পুজোসংখ্যা পড়ার ইচ্ছে ছিল, সেখানে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট হতে সরস্বতীরও মেজাজ চড়েছে। সাফ জানাল, এর আগেও ট্রাম নিয়ে বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। রাস্তা জড়ো করে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, গতি কম, জ্যামের অন্যতম কারণ… সুতরাং এবার তাকে তুলে দেওয়া হবে পাকাপাকিভাবেই, এমনটাই খবর। বোনের কথায় সায় দিয়ে লক্ষ্মীও জুড়ে দিল, তা ছাড়া লাভের গুড় তো পিঁপড়েয় খায়। মুখেই যত নস্টালজিয়ার বুলি, ট্রামে চড়ে কটা লোক! তবে কার্তিক একটা অন্য কথা বলল। তার সারাদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে বেড়ানো দেখলে দুর্গা এমনিতে বেজায় চটে যান। তবে দেখা গেল, সেই সোশ্যাল মিডিয়াতেই লোকজনের টনক নড়েছে। একবার ট্রাম বন্ধের খবর চাউর হতেই বেজায় চটেছেন শহরবাসী। কে কবে বাবার হাত ধরে ট্রামে চড়েছে, কে কবে ট্রাম-সফরেই বান্ধবীকে খুঁজে পেয়েছে, এমনই নানা নস্টালজিয়ার বুদবুদ ভেসে বেড়াচ্ছে ফেসবুকের দেওয়ালে দেওয়ালে। তবে তার মধ্যে কেউ কেউ পরিবেশ, দূষণ, এসব নিয়েও কথা বলছে বটে! ‘যা হয়েছে বেশ হয়েছে’-র দলেও নাকি গুটিকয় লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে…
এত কিছু শুনে দুর্গার মাথা ভোঁ ভোঁ করছিল। চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন করতে একবার ফোন খুললেন নিজেই। হাত রাখলেন সোশাল মিডিয়ার আইকনে। সত্যিই তাই, একের পর এক ট্রামের ছবি। তার সঙ্গে গান জুড়ে রিলস। কত কাণ্ডই না হচ্ছে। হঠাৎ একটা লেখায় দেবীর চোখ আটকাল। ট্রাম বন্ধের কারণ নিয়ে কী গুরুগম্ভীর আলোচনা! নস্টালজিয়ার সঙ্গে বাস্তববুদ্ধির তুলনা করতে গিয়ে বিশ্বায়ন থেকে পেরেস্ত্রৈকা, কী না টেনে এনেছে! কৌতূহলের বশে দুর্গা লেখকের প্রোফাইল খুলতে গেলেন। এ কী! এই তো মণ্ডপের সেই ছোকরা! যে বান্ধবীকে বারবার ট্রামে চড়ার কথা বলছিল সেদিন। আর এখন সে-ই কিনা ট্রাম বন্ধের যুক্তি সাজাতে ব্যস্ত!
মৃদু স্বরে দুর্গা বললেন, ঘোর কলি…
আরও পড়ুন: