অনাথ শিশু হ্যারিকে মাসির কাছে রেখে আসার আগে সারাদিন সেই পরিবারটিকে নজর করেছিলেন তিনি। সদ্য-স্কুলে-আসা হ্যারির উড়ে বেড়ানোর দক্ষতা দেখে তাকে বেছে নিয়েছিলেন কুইডিচের জন্য, অলক্ষে উপহার পাঠিয়েছিলেন নতুন ঝাঁটা। ভেঙে পড়ার মুখে দাঁড়ানো হগওয়ার্টসকে বাঁচাতে ছাত্রদের লড়াইয়ে পা মিলিয়েছিলেন, প্রয়োগ করেছিলেন আজীবনের জাদুর শিক্ষা। পড়ুয়াদের আগলে রাখা আর লড়াই করার পাঠ দিতে দিতে মিনার্ভা ম্যাকগোনাগল আসলে শিখিয়ে গিয়েছেন, শিক্ষককে কেমন হতে হয়।
এক-একটা সময় আসে, যখন পক্ষ নিতেই হয়। বয়স আর অবস্থান নির্বিশেষে সব মানুষকেই এক-একটা পক্ষে দাঁড়াতে হয়। বেছে নিতে হয় ভালো আর খারাপ। তার জন্য প্রয়োজনে ক্ষমতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গলা চড়াতেও হয়। সম্প্রতি তেমনই এক অস্থির সময়ে আমরা দেখা পেয়েছিলাম এক শিক্ষিকার। স্কুলপড়ুয়াদের ন্যায়বিচারের দাবি তুলতে দেখলে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে দেখলে যে দুনিয়া অস্বস্তিতে পড়ে, সেই দুনিয়ার সামনেই তিনি স্পষ্ট বলেছিলেন, যদি রাষ্ট্র ভেঙে পড়ে তাহলে ১৮ বছরের নিচের মানুষটাকেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এই স্বর যেন মিলে যায় আমাদের চেনা আরেকজন প্রধান শিক্ষিকার সঙ্গে। তিনি বাস্তবের নন, জাদু দুনিয়ার মানুষ। কিন্তু তাঁর ছাত্রছাত্রীরা যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে গলা তুলছে, চিরদিনের শৃঙ্খলাপরায়ণ সেই মানুষটি সেদিন তাদের থামার নির্দেশ দেননি। বরং তাদের দলে শামিল হয়েছিলেন। তাদের জোর বাড়ানোর জন্য, তাদের আগলে রাখার জন্যও। তিনি হ্যারি পটারের সেই ম্যাজিক স্কুল হগওয়ার্টসের শিক্ষক, প্রফেসর মিনার্ভা ম্যাকগোনাগল।
মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু কিছু দেখেননি!- ক্ষমতার ‘আতঙ্ক’ ছড়ানোর ভাষা বোধহয় এমনটাই। কেন-না ক্ষমতা জানে, ওরা যত বেশি জানে, তত কম মানে। আর না-মানার দল যদি ভারী হয়, ক্ষমতার তবে ভারী মুশকিল। সেই কারণেই, একান্ত শৈশব থেকেই মেনে নেওয়ার শিক্ষা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ক্ষমতা। আর সে কাজের জন্য সে কাজে লাগাতে চায় শিক্ষকদেরই। হ্যারি পটারের ম্যাজিক দুনিয়াও সেই ক্ষমতার খেলা দেখেছিল বইকি। দেখেছিল প্রফেসর স্নেপকে দলে টেনে কীভাবে বেয়াড়া ছাত্রদের শায়েস্তা করতে চাইছে ভলডেমর্ট। আবার এও দেখেছিল, অন্ধকার জগতের সর্বশক্তিমান লর্ডের বিপক্ষে কীভাবে সোজা দাঁড়িয়ে আছেন জনাকয়েক প্রফেসর। পটারহেডরা জানে, সেইসব শিক্ষকদের পুরোভাগে দাঁড়িয়ে দুজন মানুষ। ডাম্বলডোর ও ম্যাকগোনাগল।
আরও শুনুন:
জাদুর কাঠি ছাড়াও ম্যাজিক হয়! তুমিই শিখিয়েছ, হ্যারি
প্রফেসর ম্যাকগোনাগল কঠোর শিক্ষক। তাঁর সামনে বিন্দুমাত্র বেনিয়ম করতে ভয় পায় পড়ুয়ারা। কিন্তু প্রফেসর ম্যাকগোনাগল সেই শিক্ষকও, কড়া শিক্ষকের ব্যক্তিত্বের আড়ালে যাঁর স্নেহ বয়ে চলে অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতন। হগওয়ার্টসে পা রাখার প্রথম দিন থেকে যাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল হাউজ নির্বিশেষে হগওয়ার্টসের সমস্ত পড়ুয়াদের সমস্ত ঝড়ঝাপটা থেকে রক্ষা করে চলা। আর তার জন্য যে-কোনো সীমা অব্দি চলে যেতে কখনও পিছপা হননি তিনি। তিনি এমন একজন শিক্ষক, যাঁর কাছ থেকে আমরা শিখেছি শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে। শিখেছি নিরপেক্ষতা, আর শাসকের চোখে চোখ রেখে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। শিখেছি, যখন বিপদ এসে শিয়রে দাঁড়ায়, তখন আর ভয় পেলে চলে না। শেষবারের মতো সর্বশক্তি দিয়ে লড়ে যেতে হয় সমস্ত ‘you know who’-দের বিরুদ্ধে।
ম্যাজিক হোক বা জীবন, ‘you know who’-দের বিরুদ্ধে গলা তুলতে শেখানোই আসলে সবচেয়ে বড় শিক্ষা। আর সেই কারণেই মিনার্ভা ম্যাকগোনাগল-দের হারিয়ে যেতে দেওয়া চলে না।