শরতে দেবীর অকাল বোধন করেছিলেন রামচন্দ্র। রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার আগে টানা নয়দিন ধরে দেবীর নটি রূপের পুজো করেছিলেন শ্রীরাম। সেই থেকেই নবরাত্রি ব্রতের প্রচলন হয় মর্তে। মূলত উত্তর ভারতের উৎসব, তবে গোটা দেশেই পালিত হয় এই বিশেষ ব্রত। দেবীর কোন কোন রূপের পুজো হয় এই কদিন?আসুন শুনে নিই।
দেবী আদ্যাশক্তি মহামায়া। কখনও তিনি কাল ধারণকারী কালী। কখনও স্নেহময়ী জগন্মাতা। তিনিই আবার গিরিরাজের কন্যা। দেবীর একাধিক রূপের বর্ণনা মেলে পুরাণে। তার মধ্যে নির্দিষ্ট নটি রূপ নিয়ে তৈরি নবদুর্গা। নয়দিন ধরে দেবীর এই নটি আলাদা রূপের পুজোর চল রয়েছে। একেই নবরাত্রি ব্রত বলা হয়। নিয়ম অনুযায়ী, এই নয়দিন ব্রতীকে সম্পূর্ণ সাত্ত্বিক ভাবে থাকতে হয়। আর ব্রতের শেষে ৯ কুমারী বালিকাকে দেবীজ্ঞানে পুজো করতে হয়।
নবদুর্গার প্রথম রূপ দেবী শৈলপুত্রী। শৈল অর্থে পাহাড়। দেবী পার্বতী ছিলেন পাহাড়ের রাজা হিমালয়ের কন্যা। সেই রূপেই তিনি প্রকট হন নবরাত্রির প্রথম দিনটিতে। দেবী শান্ত, ধীর, শ্বেতবসনা। এরপরই দেবীর ব্রহ্মচারিণী রূপের কথা আসে। তাঁর পুজো হয় নবরাত্রি ব্রতের দ্বিতীয় দিনে। পুরাণমতে, দেবী পার্বতী মহাদেবকে স্বামীরূপে পাওয়ার জন্য যে কঠোর তপস্যা করেছিলেন, তারই স্বরূপ এই ব্রহ্মচারিণী। এই দেবীর মাথায় জটা, হাতে কমণ্ডলু। দেবীর তৃতীয় রূপ চন্দ্রঘণ্টা। তিনি সিংহের উপর অধিষ্ঠান করেন। হাতে ঘণ্টা থাকে বলেই দেবীর এমন নাম। এই দেবী বীরত্বের প্রতীক। দেবীর চতুর্থ রূপ কুষ্মাণ্ডা। তিনি মূলত রোগ নিরাময় করেন। এরপরই দেবীর মাতৃরূপের প্রকাশ। নবদুর্গার পঞ্চম রূপ হলেন দেবী স্কন্দমাতা। মূর্তিতে দেবীর কোলে দেখা ষড়ানন কার্তিককে। সেই কারণেই দেবীর নাম স্কন্দমাতা। দেবীর ষষ্ঠ রূপ কাত্যায়নী। প্রাচীন কিংবদন্তি অনুযায়ী, দেবী পার্বতী ঋষি কাত্যায়নের কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করে কাত্যায়নী নামে পরিচিতা হন। দেবীর সপ্তম রূপ কালরাত্রি। দেবীর অতি ভয়ংকর এক রূপ এই কালরাত্রি। সিংহ নয়, এই দেবীর বাহন গাধা। এলোকেশী, ভীষণা, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। মনে করা হয় কালরাত্রির পুজো করলে শত্রুর বিনাশ হয়। দেবী স্বয়ং অনেক অসুরকে নিধন করেছিলেন। এরপর দেবীর প্রকাশ মহাদেবের অর্ধাঙ্গিনী রূপে। অষ্টম রূপে তিনি মহাগৌরী। শিবের মতো তাঁর বাহনও ষাঁড়। দেবী চতুর্ভুজা। নবদুর্গার র্সবশেষ রূপটি হল দেবী সিদ্ধিদাত্রীর। দেবীর এই বিশেষ রূপটির পুজো করলে যে কোনও কাজেই সাফল্য অনিবার্য। শাস্ত্রমতে তিনি ভক্তদের সিদ্ধি প্রদান করেন। তাই তাঁকে সন্তুষ্ট রাখতে পারলেই যে কোনও কাজে সফলতা নিশ্চিত। যদিও নবরাত্রি ব্রতের সময় দেবীর এই নয় রূপেরই সমানভাবে পুজো করতে হয়। ফলও মেলে সর্বাঙ্গীণ ভাবেই।
বছরে একবার নয়, দুবার নবরাত্রি পালনের চল রয়েছে। বাংলায় যেমন দুর্গাপুজো আর বাসন্তীপুজো। নবরাত্রির ক্ষেত্রেও সেই একই নিয়ম। প্রথমে আশ্বিন তারপর চৈত্র। একইভাবে দুর্গার নয় রূপের পুজো করা হয়। অনেকে চৈত্র নবরাত্রিকে গুপ্ত নবরাত্রি বলে থাকেন। নেপথ্যে তন্ত্রের বিশেষ ব্যাখ্যা রয়েছে। তবে অনেকেই বাড়িতে এই ব্রত নিষ্ঠাভরে পালন করেন। নির্দিষ্ট মনের ইচ্ছা নিয়ে ব্রত করলে ফল অবশ্যই মেলে। অনেকে বলেন ঠিকমতো পালন করলে নবরাত্রি ব্রতেও দুর্গাপুজোর ফল মেলে। বিজ্ঞানের দিক দিয়ে দেখলে নবরাত্রি পালনের নেপথ্যে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। আসলে শরৎকাল আর বসন্তকাল, বছরের এই দুটি সময়ই ঋতু পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। যার জেরে নানান শারীরিক সমস্যায় ভুগতে হয় সকলকে। এবার এই সময় যদি অতিরিক্ত তামসিক আহার করা হয়, তাহলে সেই সমস্যা আরও বেড়ে যায় বই কমে না। সেই সমস্যা থেকে বাঁচতেই এই ব্রতের জন্ম। মুনি ঋষিরা সব দিক বিচার করেই ব্রতের নিয়ম তৈরি করেছিলেন। ঋতু পরিবর্তনের এই সময়কালে কেউ যদি দৈবের অছিলায় সাত্ত্বিক আহার করে, তাহলে তা অবশ্যই মঙ্গলজনক। ধীরে ধীরে এই ব্রতের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য নানান রকমের দৈব কাহিনির প্রলেপ চেপেছে। অন্যদিকে ব্রত পালনকারীরা যখন উপলব্ধি করেছেন ব্রতের ফলে শরীর আসলে সুস্থ থাকছে, তখনই তা দেবীর মাহাত্ম্য হিসেবে আরও প্রচার পেয়েছে। আর এইভাবেই দিনে দিনে অসংখ্য ভক্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে এই পূজার চল।