ছ-বছরের শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা যুবকের, আর সেই চেষ্টা রুখে দিল একদল বাঁদর। মানুষের আচরণ যেখানে চূড়ান্ত মানবিক, সেখানে ওই পশুগুলিই পরোক্ষে শিখিয়ে দিল মানবিকতার সংজ্ঞা। এরপর মানুষের নৃশংস আচরণকে পাশবিক তকমা দেওয়ার কি আর কোনও যুক্তি থাকে?
ছোটখাটো দুষ্টুমি, অকাজ-কুকাজের ক্ষেত্রে আমাদের নির্ভরযোগ্য বিশেষণ, ‘বাঁদরামি’। ছোটবেলা থেকে বড়বেলা, ছুতোয়নাতায় এই কথা শুনেই থাকি আমরা। ব্যবহারও করি নির্দ্বিধায়। কখনও কখনও মজা করে নয়, বড়সড় কোনও অপরাধের ক্ষেত্রেও এই তকমা দিই। কিন্তু কথা হচ্ছে, মানুষের অপরাধকে বাঁদরের আচরণের সঙ্গে তুলনা করার যৌক্তিকতা ঠিক কতখানি? সম্প্রতিই এ প্রশ্নে নতুন করে ভাবাচ্ছে একদল বাঁদর।
প্রজাতি হিসেবে বাঁদর বটে, যাদের আমরা মনুষ্যেতর বলতেও ছাড়ি না, তবে এই বাঁদর দলের কাজকর্ম কিন্তু মানুষকেও লজ্জা দেওয়ার মতোই। কেননা যোগীরাজ্যের এই একদল বাঁদরই একটি ছোট্ট মেয়েকে বাঁচিয়ে দিয়েছে কামুক পুরুষের থাবা থেকে। জানা গিয়েছে, ছ’বছরের শিশুটিকে নিরিবিলিতে নিয়ে গিয়ে পোশাক খুলেছিল এক যুবক। নিজের বাড়ির সামনেই খেলা করছিল শিশুটি, যৌন হেনস্তার অভিসন্ধিতে তাকে ভুলিয়েভালিয়ে ডেকে নিয়ে যায় ওই যুবক। এমনকি এ ঘটনার কথা বাড়িতে কাউকে জানালে মেরে ফেলার হুমকিও দেয়। বলাই বাহুল্য, এই সমস্ত আচরণটিই মানবিকতার একেবারে উলটোদিকে দাঁড়িয়ে। বস্তুত যতবার কোথাও না কোথাও ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে, নৃশংসতার বিচারে একটি ঘটনা আরেকটিকে টেক্কা দিয়ে যায়, ততবার সেই নৃশংসতার মাত্রা বোঝাতেই আমরা ব্যবহার করি ‘পাশবিকতা’ কিংবা ‘পশুর মতো আচরণের’ কথা। বুঝিয়ে দিই, কোনও মানুষের পক্ষে এমন নিষ্ঠুরতা আদতে অসম্ভব। কোনও মানুষ সে কাজ করলে সে আসলে পশুরই সমগোত্রীয়। অথচ আমরা ভুলেই যাই যে পশুরা ধর্ষণ করে না। এহেন জঘন্য কাজ মানুষই করে। আরেক মানুষের প্রতি সে অমানবিক হয়। এমনকি পশুকেও সে ছাড়ে না, নানা সময়ে কুকুর থেকে শিম্পাঞ্জি একাধিক প্রাণীর উপর মানুষের যৌন লালসা ফলানোর খবর প্রকাশ্যে এসেছে। সে কাজকে পাশবিক বলে মানুষের কাজের দায়ভার এড়ানো যায় না। বরং পশুরা কী করতে পারে, তার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে এই সাম্প্রতিক ঘটনায়। জানা গিয়েছে, অভিযুক্ত যে পরিত্যক্ত বাড়িতে শিশুটিকে নিয়ে গিয়েছিল, সেখানেই ঢুকে পড়েছিল একদল বাঁদর। হঠাৎ সেখানে একজন মানুষকে দেখে তেড়ে যায় তারা। তার ফলেই শিশুটিকে ফেলে পালিয়ে যায় ওই যুবক। তবে শিশুটিকে আক্রমণ করেনি বাঁদরগুলি। নিরাপদেই বাড়িতে ফিরে এসেছে সে।
আর এই ঘটনাই ভাবতে বাধ্য করছে আমাদের। একের পর এক ধর্ষণ-হেনস্তার ঘটনায় শোরগোল চারদিকে। হাজার প্রতিবাদ, আইন আদালত, কোনও কিছুই ধর্ষণ রুখতে পারেনি এখনও। এই শিশুটিও হয়তো সে তালিকায় নয়া সংযোজন হয়েই দাঁড়াত, যা কার্যত রুখে দিয়েছে বাঁদর বাহিনী। অথচ কোনও পশু যে মানুষকে তাড়া করে, তা তো আত্মরক্ষার তাগিদেই। মানুষের হাতে সে বিপন্ন হতে পারে, এই আশঙ্কা থেকেই পশু আগেভাগে সতর্ক হয়। তাহলে যে বিপন্ন হচ্ছে কিংবা হতে পারে, তার আচরণকে ‘পাশবিক’ বলে হেয় করার কোনও যুক্তি থাকে কি? নাকি মানুষকে তার থেকে আচার-আচরণে উন্নত বলে মনে করার কোনও প্রেক্ষিত তৈরি হয় আর?
বিজ্ঞান বলে, বাঁদরজাতীয় প্রাণী থেকেই বিবর্তনের ধারায় মানুষের উদ্ভব। সেই হিসাবে মানুষের পশুর তুলনায় উন্নত হওয়ারই কথা ছিল বইকি। জ্ঞান-বিজ্ঞানে মানুষ সে উন্নতি করেও চলেছে নিরন্তর। মহাকাশে যান পাঠানো থেকে বিমান তৈরি করা, পরমাণু নিয়ে গবেষণা থেকে অর্থনীতির নয়া তত্ত্ব উদ্ভাবন, আবার শিল্প-সাহিত্যে চমকপ্রদ ভাবনার সূত্র ধরিয়ে দিয়েছেন কোনও না কোনও মানুষই। কিন্তু সেই উন্নতির পাশেই তো জারি রয়ে গিয়েছে এই চূড়ান্ত মানসিক বিকার, যা অন্য কোনও মানুষকে বিপন্ন করে, তাকে নৃশংস অত্যাচারে শেষ করে দিয়ে আনন্দ পায়। এই বাঁদর বাহিনীর কার্যকলাপ প্রশ্ন তুলে গেল, বাঁদরজাতীয় প্রাণী থেকে উন্নতির দিকে এগনোর বদলে মানুষ কি বিবর্তনের ধারায় উলটো পথে পিছিয়ে যাচ্ছে ফের?