পথের পাঁচালী মানেই অপু দুর্গার গল্প। অথচ বিভূতিভূষণের এই কালজয়ী উপন্যাসে প্রথমে কোথাও ছিলই না দুর্গা। কীভাবে লেখকের কাছে এসেছিল সেই মেয়েটি? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
সেও ছিল এক শরৎকাল। সে শরতে দুর্গার আবাহন ঘটেনি, বিসর্জন হয়েছিল। সে দুর্গা দেবী নয়, সামান্য এক মানবী, যার গায়ে লেগে থাকে দুঃখ-অপমানের ধুলো। বিভূতিভূষণের চিরকালীন পথের পাঁচালীতে সে-ই শরৎদুহিতা, অকালবোধনের পর অকালমৃত্যুতে যার বিসর্জন।
অথচ, পথের পাঁচালী যখন লিখছেন বিভূতিভূষণ, তার প্রথম খসড়ায় দুর্গা কোথাও নেই। জমিদারি সেরেস্তায় কাজ নিয়ে যেতে হয়েছিল দূর ভাগলপুরের বিস্তীর্ণ এক বনাঞ্চলে। সেই একলা দিনে থাকতে থাকতে লিখে ফেললেন জীবনের প্রথম উপন্যাসটি। তার আগে না কবিতা, না গল্প, না কোনও প্রবন্ধ, কোনও পত্রিকায় সে যাবৎ কোনও লেখাই বেরোয়নি তাঁর। উপন্যাস দিয়েই তাঁর হাতেখড়ি হল বাংলা সাহিত্যে। ভাবী কাল যাকে চিনে নেবে বাঙালির সাংস্কৃতিক যাপনের এক অমোঘ অভিজ্ঞান বলে। যদিও সে উপন্যাস কোথায় ছাপা হবে, আদৌ হবে কি না- সেসব নিয়েই আরেক দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর। সে কথা আজ সবার জানা। কিন্তু যে উপন্যাস এবং তা অবলম্বনে পরবর্তী কালের ছায়াছবিতে জীবন্ত হয়ে রইল এক অবাধ্য আনমনা অস্থির কিশোরী, আর যার মৃত্যু বাঙালির মনে চিরজীবনের জন্য গেঁথে গেল তারসানাইয়ের সুরে- সেই দুর্গা ছিলই না পথের পাঁচালীর প্রথম পর্বে। তাহলে এই দুর্গাকে কোথায় পেলেন বিভূতিভূষণ?
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা করে চলা রুশতী সেন এ প্রসঙ্গে জানান লেখক পরিমল গোস্বামীর সাক্ষ্য। তাঁর কথায়, ‘বিভূতিবাবু আমাকে বললেন, “পথের পাঁচালী যখন প্রথম লিখি, তাতে দুর্গা ছিল না। শুধু অপু ছিল। একদিন হঠাৎ ভাগলপুরের রঘুনন্দন হলে একটি মেয়েকে দেখি। চুলগুলো তার হাওয়ায় উড়ছে। সে আমার দৃষ্টি এবং মন দুই-ই আকর্ষণ করল—তার ছাপ মনের মধ্যে আঁকা হয়ে গেল, মনে হলো, উপন্যাসে এ মেয়েকে না আনলে চলবে না। পথের পাঁচালী আবার নতুন করে লিখতে হলো এবং রিকাস্ট করায় একটি বছর লাগল।’ (বিভূতিভূষণ: দ্বন্দ্বের বিন্যাসে, ১৯৯৮, প্যাপিরাস, কলকাতা)
বন্ধু যোগেন্দ্রনাথ সিংহকেও বিভূতিভূষণ বলেছিলেন, ‘‘মাথার চুল উস্কো-খুস্কো, চোখে উদ্দেশহীন চাহনি, অথচ মুখে দুষ্টুমির চিহ্ন। মনে হয় স্কুল থেকে পালিয়েছে, নয়তো বাড়ি থেকে মেরে তাড়িয়েছে। এখানে দাঁড়িয়ে নতুন কিছু দুষ্টুমির মতলব আঁটছে।’’
আট-দশ বছরের মেয়েটির চোখে যেন এক ব্যথাভরা জগৎ দেখেছিলেন লেখক। তাঁর মনে হয়েছিল, ‘এই বালিকা আমার পুস্তকে যতক্ষণ পর্যন্ত স্থান না পায়, ততক্ষণ পর্যন্ত আমার লেখা ব্যর্থ ও নির্জীব।’
এক গ্রাম্য মেয়েকে দেখে বিভূতির মনে যে আশ্চর্য মায়া জন্মে যায়, তার কি কোনও ব্যক্তিগত কারণ থাকতে পারে? সাহিত্য ও জীবনের ওই সুতোটি ধরিয়ে দেন সাহিত্যের ইতিহাসকার সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। তিনি জানান, ‘…আরও একটি মেয়ে এই চরিত্রের মূলে বর্তমান। বিভূতিভূষণের সবচেয়ে ছোট বোন… তাঁকে বিভূতিভূষণ আদর করে দুর্গা বলে ডাকতেন।’ উপন্যাসের দুর্গার মতো সেই বোনও অল্প বয়সে মারা যায়। ব্যক্তিগত জীবনে বোন দুর্গার সেই হাসি-কান্না ঘেরা স্মৃতি হয়তো ফিরে ফিরে আসে দুর্গার মধ্যে। যা ছিল একলার ব্যক্তিগত শোক, তা-ই থেকে যায় সর্বজনীন আর সর্বকালীন হয়ে।